পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বেতন ২৫০ টাকা!


প্রকাশিত: ০৫:২৯ পিএম, ৩০ এপ্রিল ২০১৭
ফাইল ছবি

রোদ-ঝড়-বৃষ্টি, অসুস্থতা কিংবা শুক্র-শনিবার কোনো কিছুতেই ছুটি নেই ঢাকার পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের। সপ্তাহের প্রতিদিনই ৮ ঘণ্টা কিংবা এরও বেশি সময় কাজ করতে হয় তাদের। কোনো কারণে কাজে হাজির হতে না পালে বেতন নেই।

দৈনিক মজুরি হিসেবে যে কয় টাকা পান তা দিয়েই চলে সংসার। দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় এমন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংখ্যা সাত হাজার ৯১৬।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অধিকাংশের নেই আবাসন সুবিধা। নেই স্বাস্থ্যসেবা কিংবা সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থাও। নগরীর দেড় কোটি মানুষের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত এসব শ্রমিক পান না মানবিক অধিকারটুকুও।

শুধু মৃত্যুর পর দাফনের জন্য দেয়া হয় সাত হাজার টাকা। তবে কর্মরত অবস্থায় কেউ মারা গেলে মেয়রের বিশেষ ফান্ড থেকে একজন কর্মী ৫০ হাজার টাকা করে পান। তবে এর পেছনে খরচ হয়ে যায় সিংহভাগই।

নগরীর পরিচ্ছন্নতা কাজে নিয়োজিত থাকা এসব কর্মীরা যুগের পর যুগ ধরে কাজ করে আসলেও চাকরির নেই কোনো নিরাপত্তা। বৃদ্ধ বয়সে এসে অবসর ভাতার কোনো ব্যবস্থা নেই। দৈনিক মজুরি ও স্কেলভুক্ত- এ দুই শ্রেণির কর্মীদের দিয়ে সিটি কর্পোরেশন পরিচ্ছন্নতার কাজ করিয়ে থাকে। দৈনিক মজুরিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে মজুরি নির্ধারণ করা হয়। অভিজ্ঞ ও অনেক পুরান কর্মীরা পান দৈনিক ৫০০ টাকা। আর অপেক্ষাকৃত কম অভিজ্ঞ ও নতুন কর্মীরা পান ৪৭৫ টাকা করে। দীর্ঘসময় কাজের অভিজ্ঞতার পর ইনক্রিমেন্ট হিসেবে তাদের পারিশ্রমিক বাড়ে মাত্র ২৫ টাকা।

এক্ষেত্রে স্কেলভুক্ত কর্মীরা একটু বেশি সুবিধা পেয়ে থাকেন। পুরান কর্মীদের সর্বোচ্চ বেতন ২৫ হাজার টাকা, সর্বনিম্ন ১৪ হাজার টাকা। দুই সিটি কর্পোরেশনের স্কেলভুক্ত কর্মী রয়েছেন দুই হাজার ৩৬০ জন। বাকি পাঁচ হাজার ৫৫৬ কর্মী মাস্টার রোলে বেতন পাচ্ছেন।

রাজধানী ঢাকার রাস্তায় যেসব পরিচ্ছন্নকর্মী কাজ করছেন তাদের অনেকেই আবার অন্যের কাজের প্রক্সি দেন। এক্ষেত্রে মূলকর্মী তার প্রক্সিকর্মীকে নিজের বেতনের অর্ধেকের চেয়েও কম অর্থ দেন। সে হিসেবে একজন কর্মী পান ২৫০ টাকা কিংবা এর চেয়েও কম। সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীদের প্রায় ৪০ শতাংশই অন্যের পরিবর্তে কাজ করেন।

বর্তমানে ৭০ শতাংশ পরিচ্ছন্নতাকর্মীর থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। তারা ফুটপাত কিংবা বিভিন্ন বস্তিতে বসবাস করছেন।

সম্প্রতি কর্মীদের দুর্দশার এমন চিত্র দেখে কয়েকটি উদ্যোগের কথা বলছে সিটি কর্পোরেশন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থা দু’টি। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য আবাসন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় গণকটুলী ক্লিনার কলোনিতে ছয়টি, মিরনজল্লা ক্লিনার কলোনিতে তিনটি ছয় তলা ভবন এবং ধলপুর ক্লিনার কলোনিতে একটি এক তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া একটি দো’তলা ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করে ছয় তলা ভবন নির্মাণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।

এছাড়া ক্লিনারদের জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর কর্তৃক ১৩টি দশ তলাবিশিষ্ট ভবনে মোট এক হাজার ১৪৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের স্থায়ী কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী নেই। অস্থায়ীভাবে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কর্মীরা কাজ করছেন।

তিনি বলেন, কর্মরত অবস্থায় কেউ যদি মারা যান তাদের দাফনের জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকে সাত হাজার টাকা দেয়া হয়। এছাড়া পরবর্তীতে একজন কর্মীকে ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়। বর্তমানে কর্মীদের জন্য নিজস্ব কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র না থাকলেও তাদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া মৃত কর্মীদের স্ত্রী কিংবা সন্তানরা চাইলে তাদের মাস্টার রোলে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে, উত্তর সিটির পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় আটশ পরিচ্ছন্নকর্মীর জন্য আবাস নির্মাণ করা হবে। এ বিষয়ে উত্তর সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর আব্দুর রাজ্জাক জাগো নিউজকে বলেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের চাকরি শেষ হওয়ার পর পেনশনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাদের চাকরির বিধিমালায় এমন কোনো বিধান রাখা হয়নি। তবে কর্মীদের কেউ মৃত্যুবরণ করলে আমরা একটা অ্যামাউন্ট তাদের দিয়ে থাকি। আবার তাদের যোগ্য কোনো উত্তরসূরি থাকলে অনেক সময় চাকরি দেয়ার ব্যবস্থা করি। বর্তমানের তাদের জন্য যে আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে তা অপ্রতুল।

পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য নতুন কিছু প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের দুঃখ-দুর্দশা অনেকটা কমে যাবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মী কামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাগো আবার পহেলা মে কী? কাম করলে টাকা পাই, না করলে উপোস থাহি। দিন-রাইত কাম করি। বৃষ্টি-রোদে রাস্তায় থাকি। আমাগোরে নিয়ে কেউ ভাবে না। অহন আপনে-তো একবার জিগাইলেন। মনটারে সান্তনা দিতে পারছি।’

তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুরশিদা নামে আরেক কর্মী জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্যার দেহেন আমি অনেকজনের পরিবর্তে কাজ করি। গত ১০ বছর ধরে কাজ করে আসছি। কিন্তু সিটি কর্পোরেশন যে টাকা দেয় তার অর্ধেক আমার মূল ব্যক্তি নিয়ে যায়। অথচ হে কাম করে না। এমন শত শত লোক আছে। যাগো ঢাকায় বাড়ি আছে। কিন্তু পরিচ্ছন্নকর্মীর খাতায় নাম লেখায়ে আমাগো আয়ে ভাগ বসায়। সে যদি কাম না করে তাহলে তাদের-তো বাদ দেয়া উচিত।’

উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ষাটোর্ধ্ব পরিচ্ছন্নতাকর্মী মোশাররফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কে দিব আমাগো থাকার জায়গা। ফুটপাত আর বস্তিতে থাকি। রাতে আইসা রাস্তা পরিষ্কার করি। যেকয় টিহা পাই তাই দিয়া পোলা-পাইন নিয়া দিন কাটাই।’

এমএসএস/এমএআর/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।