ভরণ-পোষণের জন্য শিশুকে নিয়ে আদালতে ঘোরেন মা

সন্তান ছেলে বা মেয়ে হোক, প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তার ভরণ-পোষণের দায়দায়িত্ব বাবার ওপরই থাকে। সেজন্য কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলে কিংবা স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করলে নাবালক সন্তানের ভরণ-পোষণ দিতে হয় বাবাকেই। কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় এর উল্টো চিত্র। পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা কলহের জেরে আলাদা বসবাস বা বিচ্ছেদের পর অনেক বাবাই সন্তানের দায়িত্ব নিতে চান না। দিতে চান না ভরণ-পোষণ। নিরূপায় হয়ে আদালতের দ্বারস্ত হন সন্তানের মা। দিনের পর দিন সন্তানের ভরণ-পোষণ চেয়ে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হয় অসহায় মাকে।
ঢাকায় কলহের মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম তিনটি পারিবারিক আদালতে পরিচালিত হয়। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে (২০১৬-২০২০ সাল) পারিবারিক আদালতে ৩৯ হাজার ৭২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বিচার করার পর্যাপ্ত উপাদান না থাকায় পাঁচ হাজার ৩০টি মামলা খারিজ হয়েছে। এক হাজার ২৫২টি মামলার রায় হয়েছে। এর মধ্যে ভরণ-পোষণ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৬৫ শতাংশ।
২০১৬ সালে পারিবারিক মামলা হয়েছে সাত হাজার ১০৩টি। এর মধ্যে খারিজ হয়েছে এক হাজার ২৪০টি এবং রায় হয়েছে ৩৩৫টি মামলার। পরের বছর ২০১৭ সালে পারিবারিক মামলা হয়েছে সাত হাজার ৩৩০টি। এর মধ্যে খারিজ হয়েছে ৯৮১টি এবং রায় হয়েছে ২৯৪টি মামলার। ২০১৮ সালে পারিবারিক মামলা হয় হয়েছে সাত হাজার ৪৯২টি। এর মধ্যে খারিজ হয়েছে ৭৪১টি এবং রায় হয়েছে ১৯০টি মামলার। ২০১৯ সালে পারিবারিক মামলা হয়েছে নয় হাজার ৩৪৫টি। এর মধ্যে খারিজ হয়েছে এক হাজার ৩৯১টি এবং রায় হয়েছে ২৭৫টি মামলার। গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে পারিবারিক আইনে মামলা হয়েছে আট হাজার ৪৫২টি। এর মধ্যে খারিজ হয়েছে ৬৭৭টি মামলা এবং রায় হয়েছে ১৫৮টি মামলার। দেখা যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক কলহের মামলা বেড়েই চলছে।
সন্তান জন্মদানে অস্ত্রোপচারের খরচ ও ভরণ-পোষণ চান রাবেয়া
রাবেয়া আক্তার (ছদ্মনাম) বসবাস করতেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ব্যবসায়ী সুজনের (ছদ্মনাম) সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর সাংসারিক জীবন ভালোই চলছিল দুজনের। পরের বছর হঠাৎ রাবেয়ার কাছে সুজন যৌতুক হিসেবে তিন লাখ টাকা দাবি করেন। রাবেয়ার পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল না হওয়ায় এ টাকা দিতে পারেনি। এতে সংসারে দেখা দেয় অশান্তি।
এর মধ্যে রাবেয়ার গর্ভে আসে সন্তান। কিন্তু যৌতুকের টাকা না দেয়ায় তাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেন সুজন। অসহায় রাবেয়ার ঠাঁই তার গরিব বাবার কাছে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কন্যাসন্তানের জন্ম দেন রাবেয়া। সেই অস্ত্রোপচারে খরচ হয় ৩০ হাজার টাকার মতো। রাবেয়ার পরিবার অনেক কষ্টে এই টাকা জোগাড় করে। সুজনের পরিবারের কাছে টাকা চাইলে তারা উল্টো রাবেয়ার পরিবারকে হুমকি দেয়। কন্যাসন্তানকে দেখা তো দূরে থাক, তার কোনো খোঁজ-খবরও নিতেন না সুজন। রাবেয়ার পরিবার বারবার অস্ত্রোপচার ও ভরণ-পোষণের টাকার জন্য সুজনের কাছে আকুতি জানায়। কিন্তু এতে তিনি কর্ণপাত করেননি। উল্টো হুমকি দিতে থাকেন।
উপায় না পেয়ে ২০১৮ সালের শেষ দিকে ঢাকার আদালতের দ্বারস্থ হন রাবেয়া। মামলা করে তিনি অস্ত্রোপচারের খরচ ৩০ হাজার টাকা, কন্যাসন্তান সাবালিকা না হওয়া পর্যন্ত ভরণ-পোষণ বাবদ প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা এবং এককালীন আরও ৩০ হাজার টাকা চান সুজনের কাছে। মামলার পর সন্তানকে নিয়ে আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন রাবেয়া। তার আশা, আদালতের মাধ্যমে কন্যার অস্ত্রোপচার ও ভরণ-পোষণের টাকা পাবেন।
বিচ্ছেদের পর নাবালক সন্তানদের ভরণ-পোষণ বাবা না দিলে বিপাকে পড়েন মা
মামলার বিষয়ে রাবেয়া জাগো নিউজকে বলেন, সুজনের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার পরের বছরই তিনি যৌতুক চান। যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় সুজন আমাকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দেন। এর মধ্যে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আমার কন্যাসন্তান হয়। আমার বাবা গরিব মানুষ। তিনি অস্ত্রোপচারের টাকা অনেক কষ্টে জোগাড় করেছেন, এখন আমার সন্তানের ভরণ-পোষণ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সুজনের পরিবারের কাছে টাকা চাইলে তারা দিতে পারবে না বলে জানায়। আমি এর প্রতিকার চেয়ে আদালতে মামলা করেছি। হাজিরা দিতে আমাকে প্রায় সময় আদালতে আসতে হচ্ছে। শিশুসন্তান নিয়ে আদালতে আসা কষ্টকর। আমি এর সহজ প্রতিকার চাই।
মামলার বিবাদী সুজন বলেন, সন্তানের অস্ত্রোপচারের খরচ ও ভরণ-পোষণের জন্য রাবেয়া মামলা করেছে। আদালতের মাধ্যমে এর সুরাহা হবে।
প্রতিকারের আশায় শিশুসন্তান নিয়ে আদালতে ঘোরেন মালিহা
মালিহা মেরির (ছদ্মনাম) সঙ্গে ২০১২ সালের শেষ দিকে বিয়ে হয় ব্যবসায়ী তৌহিদুলের (ছদ্মনাম) সঙ্গে। বিয়ের পর প্রথম দিকে মেরির ঢাকার মুগদায় নিজের বাসায় থাকতেন তৌহিদুল। পরে তারা ভাড়া বাসা নেন। কিছুদিন বেশ সুখেই কাটছিল দুজনের সংসার। ঘর আলো করে আসে দুই পুত্রসন্তান। এর মধ্যে তাদের সাংসারিক জীবনে কলহ দেখা দিতে থাকে। এক সময় দুজন আলাদা হয়ে যান।
ঢাকা মহানগর আদালত
মেরি ছোট সন্তানকে নিয়ে বাবার বাসায় চলে যান। বড় ছেলেকে নিয়ে তৌহিদুল থাকেন আলাদা ভাড়া বাসায়। ছোট ছেলের ভরণ-পোষণসহ সাংসারিক জীবনের কিছু বিষয়ে তাদের মধ্যে আপসনামা হয়। কিন্তু তৌহিদুল আপসনামার শর্ত ভেঙে ফেলেন। ২০১৯ সালের প্রথম দিকে মেরিকে তালাকও দেন তিনি। তালাকের পর মেরির কোনো খোঁজখবর নেননি। এমনকি ছোট ছেলের ভরণ-পোষণের কোনো টাকাও দেননি।
এ সংকটে পড়ে মেরি ছেলের ভরণ-পোষণের জন্য ২০১৯ সালের মাঝামাঝি তৌহিদুলের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে মামলা করেন। মামলায় ছেলের ভরণ-পোষণের জন্য প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা এবং এককালীন ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। মামলার পর ছোট ছেলেকে নিয়ে প্রায় সময় আদালতে আসেন মেরি। সমাধানের আশায় ঘোরেন আদালতের বারান্দায়। তার আশা একদিন এর প্রতিকার পাবেন।
মালিহা মেরি জাগো নিউজকে বলেন, ছেলের ভরণ-পোষণ চেয়ে আদালতে মামলা করেছি। মামলায় প্রায়ই আমাকে আদালতে হাজিরা দিতে আসতে হয়। ছোট ছেলেকে নিয়ে আদালতে আসা-যাওয়া অনেক কষ্টকর। তারপরও ছেলের ভরণ-পোষণের জন্য সংগ্রাম করছি। একদিন না একদিন আমি এর প্রতিকার পাবো বলে আশাবাদী।
মামলার বিবাদী তৌহিদুল বলেন, সন্তানের ভরণ-পোষণ চেয়ে মেরি আমার নামে মামলা করেছেন বলে জানতে পেরেছি। আদালতের মাধ্যমেই ন্যায়-অন্যায় প্রমাণিত হবে।
বিচ্ছেদের পর নাবালক সন্তানকে তত্ত্বাবধানে রাখার সুযোগ পান মা, তবে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব থাকে বাবার ওপর
সন্তানের ভরণ-পোষণের বিষয়ে আইনে যা আছে
১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ও ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সন্তানদের ভরণ-পোষণ দেয়ার দায়িত্ব আইনগতভাবে বাবার। সাবালক হওয়া পর্যন্ত ছেলেকে এবং বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত মেয়েকে বাবা ভরণ-পোষণ দেবেন। কোনো অসুস্থ ও অক্ষম সন্তান থাকলে তাদের ভরণ-পোষণও দেবেন বাবা। সাবালকত্ব অর্জন করার পরও যদি সন্তান নিজ ভরণ-পোষণ জোগাতে ব্যর্থ হন, তবে আইনানুসারে ওই সন্তান বাবার কাছে ভরণ-পোষণ দাবি করতে পারবেন। এক্ষেত্রে বাবা ভরণ-পোষণ দিতে বাধ্য নন। মা যদি সন্তানের জিম্মাদারও হন, তখনো বাবা ভরণ-পোষণ দেবেন।
এ বিষয় আইনজীবী মলয় কুমার সাহা বলেন, অনেক বাবা সন্তানের ভরণ-পোষণ দিতে চান না। এজন্য সন্তানের মা আদালতে মামলা করেন। মামলার পর সন্তানকে নিয়ে আদালতে উপস্থিত হন তিনি। আদালতে এসে ভোগান্তির শিকার হতে হয় সেই নারীকে। একজন বিচারক যদি স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ বা তাদের আলাদা হওয়ার সময় সন্তানের ভরণ-পোষণ কী পরিমাণ দিতে হবে, তা ঠিক করে দেন, তাহলে কোনো নারী ও তার সন্তানকে এমন ভোগান্তিতে পড়তে হয় না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সন্তানের ভরণ-পোষণ নির্ধারিত হয় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। এটা নির্ভর করে বাবার সামাজিক ও কাজের স্ট্যাটাসের ওপর। দাবিকৃত ভরণ-পোষণ পুরোপুরি নাও পেতে পারেন বাদী। বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। আবার অনেক নারী বিবাদীর সামর্থ্যের বাইরে গিয়েও দাবি করেন। যে কারণে কাঙ্ক্ষিত রায় অনেক সময় আসে না।
আইনজীবী তাহেরুল ইসলাম তৌহিদ বলেন, সন্তানের ভরণ-পোষণ দেয়ার দায়দায়িত্ব বাবার। অনেক সময় বাবা এ দায়িত্ব পালন করতে চান না। ফলে সন্তানের মা আদালতে মামলা করেন। মামলা করে তাকে আসতে হয় আদালতে। আদালতে এসে তাকে শিকার হতে হয় ভোগান্তির। প্রত্যেক বাবারই দায়িত্ব সন্তানের ভরণ-পোষণ দেয়া। তাহলে আর সন্তানের মাকে মামলা করতে হয় না। সন্তানকে নিয়ে আদালতপাড়ায় এসে ভোগান্তিরও শিকার হতে হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আয়েশা সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, শিশুরা আদালতের পরিবেশ দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। মানসিক বিকাশেও তারা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাদের কোমল মন শক্ত হয়ে যায়। মানুষের প্রতি তাদের আস্থা কমতে থাকে। এর প্রভাব তাদের সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়। শিশুদের বিনা প্রয়োজনে আদালতে নেয়া মোটেও ঠিক নয়। যতদূর সম্ভব তাদের আদালতের বাইরে রাখতে হবে। এতে শিশুরা মানসিক সমস্যায় ভুগবে না।
জেএ/এইচএ/এএসএম