রশিদের ঘূর্ণিতে স্বপ্ন দেখছে আফগানরা

স্পোর্টস ডেস্ক
স্পোর্টস ডেস্ক স্পোর্টস ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:২৩ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২১

জীবন বড়ই বিচিত্র। যুদ্ধবিদ্ধস্ত এক দেশ থেকে জানের ভয়ে পালিয়ে বেড়ান ছেলেটি, এখন সে দেশের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন। এক সময় শরনার্থী হিসেবে অন্য দেশে দিন যাপন করলেও, এখন বল হাতে ঘূর্ণি জাদুতে তিনি শাসন করছেন ক্রিকেট বিশ্ব। কথা হচ্ছে আফগান তারকা স্পিনার রশিদ খানকে নিয়েই।

আর পাঁচটা ছেলের মতো জন্মের পর থেকে যুদ্ধ দেখেই বড় হওয়া রশিদের। একটা সময় তার পরিবার জীবন বাঁচাতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিলো পাকিস্তানের পেশোয়ারে। রশিদের ছেলেবেলার অনেকটা কাটে সেখানেই। একটা সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, দেশে ফেরেন তিনি। এরপর থেকেই জীবনের চাকা অন্যভাবে ঘুরতে শুরু করে এই স্পিন বিস্ময়ের।

আফগানিদের ক্রিকেট প্রেম আজকের নয়। যে তালেবান অন্য অনেক খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে, তাদেরও পছন্দের খেলা এই ক্রিকেট। প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর তাদের সুবাদেই আফগানিস্তানে ক্রিকেট প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই প্রভাবটা পড়ে তখনকার সব শিশুদের ওপর। রশিদ ছিলেন তাদেরই একজন।

ভবঘুরে জীবনে যখনই বল নামক প্রায় ৬ আউন্সের চর্মগোলকটি হাতে পেয়েছেন রশিদ, তখনই চেষ্টা করেছেন নিজের স্বকীয়তা দেখানোর। লেগ স্পিনে বুঁদ করে রাখতেন তিনি। রশিদের প্রিয় ক্রিকেটার পাকিস্তান কিংবদন্তি শহিদ আফ্রিদি। যিনিও করতেন লেগ স্পিন। প্রিয় তারকাকে অনুসরণ করেই লেগ স্পিন করতেন। এক সময় যা আফগান ক্রিকেট কর্তাদের নজরে এসে পড়ে।

জাতীয় দলে অভিষেকের পর থেকেই হু হু করে বাড়তে লাগে রশিদের জনপ্রিয়তা। সেটা মাঠে বল হাতে তার দেখানো জাদুর কল্যাণেই। ভয়ঙ্কর সব গুগলি, ফ্লিপার, প্রথাগত লেগি স্পিন আর আর্ম বলে বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দের বশ করে বিশ্ব ক্রিকেটের পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে বেশি সময় লাগেনি তার।

এখন তো ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট মানেই রশিদকে নিয়ে কাড়াকাড়ি। শুধু টি-টোয়েন্টি নয়, অন্য দুই ফরম্যাটেও সফলতার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন রশিদ। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপ দিয়ে প্রথমবার আইসিসির কোনো বৈশ্বিক আসরে খেলেন এই স্পিনার। আফগানিস্তান কোনো ম্যাচ না জিতে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও, রশিদ ছিলেন সমহিমায় উজ্জ্বল। নিলেন আসরে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ১১ উইকেট।

শুধু ওই আসর কেন, আফগানিস্তানের জন্য বরাবরই ‘কি-ফ্যাক্টর’ তিনি। দলের স্ট্রাইক বোলার। উইকেট প্রয়োজন? ডাকুন রশিদকে। প্রতিপক্ষের রান আটকাতে হবে তো? ডাকুন রশিদকে। যে দলেই রশিদ থাকুক না কেন, সে দলের অধিনায়ক বিপদে-আপদে খোঁজেন রশিদকে। সেটা তার বুদ্ধিদীপ্ত আর জাদুকরী বোলিংয়ের জন্যই।

দেরাদুনে বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সেই টি-টোয়েন্টি সিরিজের কথা মনে আছে তো? বাংলাদেশকে তিন ম্যাচের সিরিজে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা দিয়েছিল আফগানরা। প্রতিপক্ষ হিসেবে দুর্বল হলেও আফগানদের হয়ে বাংলাদেশের মনে ভয়টা ধরিয়ে দিয়েছেন এই লেগিই। হয়েছিলেন প্রথম ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়, পরে সিরিজ সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও ওঠে তার হাতে।

সেই সিরিজ ছাড়াও জাতীয় দলে মাত্র ৬ বছরের মধ্যে কত কীর্তি তার। জাতীয় দলের হয়ে সিনিয়র-অভিজ্ঞদের সেই কবে পেছনে ফেলে তিন ফরম্যাটে সর্বোচ্চ উইকেট (২৬৭) শিকারির মালিকানা তিনি করে নিয়েছেন নিজের নামে। আফগান বরপুত্র রেকর্ড গড়তে ভালোবাসেন। সেই ভালোবাসার ধারা এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ধরে রাখলে দল হিসেবে আরও পরিণত হয়ে ওঠা আফগানরা ঘটাতে পারে যে কোনো অঘটন।

বিশ্বকাপে মূল সাফল্য অর্জনের লক্ষ্য এবার পূরণ হতে হবে এমন ভাবছেন না রশিদ। তবে এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জিততে চান বিশ্বকাপ শিরোপা। আইসিসির একটি আয়োজনে বিশ্বকাপ ভাবনা নিয়ে রশিদ বলেন, ‘আমরা ভবিষ্যতের লক্ষ্য স্থির করেছি যে, একদিন বিশ্বকাপ জেতার সামর্থ্য হবে আমাদের, বিশেষ করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। দেশে থাকা সবার মনোযোগ সেখানেই।'

নিজেদের সপ্নের কথা জানাতে গিয়ে এই তারকা ক্রিকেটার আরও বলেছেন, ‘এটাই সবার স্বপ্ন, প্রতিটা ক্রিকেটারের লক্ষ্য। আমরা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম। দক্ষতা ও নিজেদের ওপর বিশ্বাস আছে আমাদের। আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে সেই লক্ষ্য অর্জন করতে যাচ্ছি আমরা।’

ভবিষ্যৎ তুলে রাখা যাক, তবে বড় একটা ধাক্কাকে সঙ্গী করে নিয়েই এবারের বিশ্বকাপে খেলতে নামবেন রশিদ। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর কার্যত দেশটির ক্রিকেট বোর্ডও চালাচ্ছে তারা। রশিদ দলের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হলেও, তার অভিমত নেয়া ছাড়াই তালেবান শাসিত বোর্ড বিশ্বকাপ দল ঘোষণা করে দেয়। এই অভিমানে অধিনায়কত্বই ছেড়ে দেন রশিদ। বোর্ডের এমন আচরণে, কষ্ট পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এই কোন্দল না আবার আফগান ক্রিকেটকে, রশিদের পথচলাকে উল্টো পথে নিয়ে যায়!

তবে নামটা রশিদ বলে আশ্বস্ত হতেই পারেন আফগানরা। বোমা-বারুদের মধ্যে থেকে, যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে বড় হয়ে ওঠার পর রশিদের কাছে কোনো চ্যালঞ্জই যেন চ্যালেঞ্জ নয়। জীবনে-যুদ্ধে যে জয়ী, তাকে মাঠের যুদ্ধে হারাবে কে? শক্ত মানসিকতার রশিদ তাই, এই চ্যালেঞ্জকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সফল হবেন, তার পক্ষে বাজি ধরার লোকেরও অভাব হচ্ছে না।

রশিদ নিজেও সেটা চাইবেন। চাইবেন, বল হাতে কখনো আবার ব্যাটিংয়ে দলকে আনন্দের উপলক্ষ দিয়ে আরেকটি যুদ্ধে জয়লাভের।

এসএস/আইএইচএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।