‘স্বপ্নটা তৈরি হয়েছিল নারী সাঁতারু নাসরিনের সাফল্যের কারণে’

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৬:৩৮ পিএম, ৩০ জুলাই ২০২৫

এশিয়ার প্রথম সাঁতারু হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ব্রজেন দাস। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যে তিনি ছয়বার এই চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৬৫ সালে আবদুল মালেক ও ১৯৮৭ সালে মোশাররফ হোসেন সফলভাবে পাড়ি দিয়েছিলেন এই চ্যানেল। সর্বশেষ গতকাল (মঙ্গলবার) বাংলাদেশের দুই সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর ও নাজমুল হক হিমেল চ্যানেলটি পাড়ি দিয়েছেন।

উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের যে অংশটি যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে আলাদা করেছে, তার সবচেয়ে সরু অংশটি ৩৪ কিলোমিটারের মতো চওড়া। এটিইি বিশ্বের কাছে ইংলিশ চ্যানেল (english channel) নামে পরিচিত। এই চ্যানেল পাড়ি দেওয়া একজন সাঁতারুর (swimming) জন্য যেমন কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং কাজ, তেমন মর্যাদারও।

সেই ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জন করে ৩৭ বছর পর ইতিহাসে নাম লেখালেন বাংলাদেশের আরও দুই সাঁতারু। কেমন ছিল চ্যালেঞ্জ? চ্যানেল পাড়ি দিতে কী কী প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল? এসব নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে জাগো নিউজের বিশেষ সংবাদদাতা রফিকুল ইসলামকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সাবেক জাতীয় সাঁতারু ও অলিম্পিয়ান মাহফিজুর রহমান সাগর।

জাগো নিউজ: ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেবেন সেই স্বপ্ন কবে থেকে দেখছিলেন?
মাহফিজুর রহমান সাগর: আসলে ছোটবেলা থেকে যখন ব্রজেন দাসের ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার কথা জেনেছিলাম, তখন একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। আর স্বপ্নটা তৈরি হয়েছিল নারী সাঁতারু তাহরিনা নাসরিনের সাফল্যের কারণে।

জাগো নিউজ: সেটা কেমন, যদি বিস্তারিত বলতেন।
মাহফিজুর রহমান সাগর: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এই নারী সাঁতারু ২০১৫ সালে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন। তখন আমি সাঁতারে পিকফর্মে। তার সাথে যোগাযোগ করেছিলাম। তিনি সম্মতও হয়েছিলেন। পরে ব্যক্তিগত কারণে পারেননি। ২০২৩ সালের দিকে হিমেলকে বলি যে, আমরা দুজন ও ভারতের দুজন মিলে ইন্দো-বাংলা টিম করে চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা করি। তারপর থেকে চেষ্টা করে এতদিনে সফল হয়েছি।

মাহফিজুর রহমান

জাগো নিউজ: শেষ পর্যন্ত তো চারজনের পরিবর্তে ছয়জনের রিলে টিম হলো, তাই না?
মাহফিজুর রহমান সাগর: হ্যাঁ। প্রথমে চারজনের রিলে করার কথা ছিল। আমরা বাংলাদেশের দুজন এবং ভারতের দুজন। শেষ পর্যন্ত আমরা দুজন, ভারতের তিনজন ও মেক্সিকোর একজনসহ ছয়জনের রিলে টিম করে চ্যানেল পাড়ি দিয়েছি। এটা ইন্দো-বাংলা টিম হিসেবেও কাউন্ট হতে পারে, আবার ইন্টারন্যাশনাল টিম হিসেবেও কাউন্ট হতে পারে।

জাগো নিউজ: চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার জন্য আপনাকে কতদিন অপেক্ষা করতে হলো?
মাহফিজুর রহমান সাগর: ইংল্যান্ডে আসার ২৬ দিন পর সাঁতারের শিডিউল পেয়েছি। অনুশীলন করেছি তিন সপ্তাহের মতো। আবহাওয়ার কারণে শিডিউল পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে।

জাগো নিউজ: গতকাল যখন চ্যানেল পাড়ি দিলেন, তখন পানি কেমন ঠান্ডা ছিল? আবহাওয়া কেমন ছিল?
মাহফিজুর রহমান সাগর: তাপমাত্রা ছিল ১৭ ডিগ্রি। বাতাস বেশি ছিল। তাই উত্তাল ঢেউ ছিল।

জাগো নিউজ: র‌্যালির নিয়মটা কী? আপনি কখন পানিতে নেমেছিলেন?
মাহফিজুর রহমান সাগর: সবাইকে এক ঘণ্টা করে সাঁতরাতে হয়। এক ঘণ্টা পর আরেকজন নামেন। সবাই বোর্ডেই থাকেন। আমি প্রথমে সাঁতরিয়েছি। তারপর হিমেল। এভাবে আমি সবচেয়ে বেশি তিনবার সাঁতরিয়ে ফিনিশিংয়ে ছিলাম।

জাগো নিউজ: শেষ হওয়ার পর সেখানে পরিবেশটা কেমন ছিল?
মাহফিজুর রহমান সাগর: চ্যানেলের দূরত্ব ৩৪-৩৫ কিলোমিটারের মতো। তবে সাঁতরানো হয় প্রায় ৪০ কিলোমিটারের মতো। আমি যখন একটু দূর থেকে মেইনল্যান্ড দেখাচ্ছিলাম, তখন বোর্ডের চালক বলছিলেন ঠিক সময়মতো পৌঁছে যাবো। ধারণা করা হয়েছিল, আরও ঘণ্টাখানেক লাগতে পারে। একসময় মনে হয়েছিল হিমেলকে নামা লাগতে পারে। শেষ পর্যন্ত ১০-১২ মিনিটের মধ্যেই আমি পৌঁছে যাই বলে হিমেলকে তৃতীয়বার নামতে হয়নি।

জাগো নিউজ: কেমন প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল চ্যানেল পাড়ি দিতে?
মাহফিজুর রহমান সাগর: প্রথম থেকেই তো প্রতিকূলতা ছিল। তবে সমস্যা বেশি হয়েছিল, পানিতে নামার আগেই আমার বমি হয়েছিল। সবমিলিয়ে ৭-৮ বার আমার বমি হয়েছিল। কিছুটা অসুস্থ হবো বলে ধারণা ছিল। তবে বমি হবে ভাবিনি কখনো।

জাগো নিউজ: তখন কি কোনো শঙ্কা কাজ করছিল? পাড়ি দিতে পারবেন কি পারবেন না?
মাহফিজুর রহমান সাগর: আমার একটা লক্ষ্য ছিল, পারতে হবেই। আমি সাঁতারু, যত বমিই হোক হাল ছাড়বো না। বমি বারবার হওয়ায় একটা সময় দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছিল। তবে কখনো সাহস হারাইনি।

‘৭-৮ বার বমির পর একটু দুশ্চিন্তা হলেও সাহস হারাইনি’

জাগো নিউজ: চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার পর কি কোনো সনদ দেওয়া হয়েছে আপনাদের?
মাহফিজুর রহমান সাগর: সনদ নিতে হয় অর্থের বিনিময়ে। ৭০ থেকে ৮০ পাউন্ড লাগে। তবে চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার দেড়শ বছর উদযাপন উপলক্ষে এবার সবাইকে সৌজন্য পদক দেওয়া হয়েছে।

জাগো নিউজ: চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার পর ঢাকায় প্রথমে কার সঙ্গে কথা বলেছিলেন?
মাহফিজুর রহমান সাগর: প্রথমেই আমি ঢাকায় স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি। সে দিনভর টেনশনে ছিল। মা তখন ঘুমিয়েছিলেন বলে কথা বলতে পারিনি। সকালে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি।

জাগো নিউজ: শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন পূরণ হলো। কেমন বোধ করছেন এখন?
মাহফিজুর রহমান সাগর: এটা তো বিশাল ব্যাপার। অনেক দিনের স্বপ্ন পূরণ হওয়ায় আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছি। ফ্রান্সের উপকূলে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল আমি পেরেছি, আমরা পেরেছি। আগামীতে কত গল্প লেখা যাবে এ নিয়ে!

জাগো নিউজ: ধন্যবাদ।
মাহফিজুর রহমান সাগর: আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরআই/এমএমআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।