দুই হাজার প্রভাবশালীর দখলে চট্টগ্রামের ৩৯ খাল
প্রভাবশালীদের দখলে চট্টগ্রাম মহানগরীর ৩৯টি খাল। অবৈধভাবে দখল করে ভরাট করে ফেলা হয়েছে এসব খালের প্রায় সবগুলোই। রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব রয়েছে এসব দখলদারদের।
জবর দখলকারীর তালিকায় আছে সিটি কর্পোরেশন, কয়েকটি আবাসন কোম্পানিসহ আরো বেশ কয়েকটি সংস্থা। দখলকারীরা ভরাটকৃত এসব খালে গড়ে তুলছে বসতি, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বিভিন্ন সময় খালগুলো উদ্ধারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) উদ্যোগ নিয়েও ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আবার চসিক নিজেই দখলে রেখেছে কয়েকটি খাল।
নগরীর ৩৯ খালের মোট দখলদারের সংখ্যা এখন ২ হাজার ২২১। সাম্প্রতিক সময়ে চসিক ও জেলা প্রশাসনের যৌথ সার্ভের মাধ্যমে এসব দখলদারদের চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু এখনো এসব দখরদারদের উচ্ছেদের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
দখলদারদের উচ্ছেদ প্রসঙ্গে চসিকের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতরের সহযোগিতা নিয়ে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। ইতোমধ্যে দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তবে সেই তালিকা নিয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। আগে এ জঠিলতা নিরসন হতে হবে।
তিনি বলেন, খালের সীমানা আরএস খতিয়ান অনুযায়ী নাকি বিএস খতিয়ান ভিত্তিক হবে তা নিয়েই মূলত জটিলতা। এ জঠিলতা নিরসন হলে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে। দখলদারদের কোনো ধরনের ছাড় দেয়া হবে না। সবগুলো খাল ও খালের পাড় দখলমুক্ত রাখা হবে।
নগরীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাল হিসেবে দেখা হয় চাক্তাই খালকে। চাক্তাই খাল দখল করে আছেন ৪৮ অবৈধ দখলদার। সাত কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে খালটির ৮২ শতাংশই অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন তারা।
এসব দখলদাররা রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা ধরনের প্রভাব বিস্তার করে খালের জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন বহুতল ভবন, কেউ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কেউ আবার সেখানে ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন। গড়ে উঠেছে বাজারও।
সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন ও সদর সার্কেল ভূমি অফিস নগরীর সবগুলো খালের দখলদারদের খুঁজে বের করতে যৌথ সার্ভে পরিচালনা করে। এতে চাক্তাই খালে ৪৮ দখলদারের নাম আসে।
একইভাবে শীতল ঝর্না খাল, মরিয়ম বিবি খাল, হিজড়া খাল, মনোহর, নাসির, চশমা, জামালখান. গুপ্ত ছড়া খাল, দেব পাহাড় ও গুলজার খালসহ নগরীর প্রধান ১৬ খালের ও শাখা খালের দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে মোট দখলদার চিহ্নিত করা হয়েছে ২ হাজার ২২১ জনকে।
যৌথ সার্ভেতে অংশ নেয়া এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নগরীর সবগুলো খালের দখলদারদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে ২ হাজার ২২১ জনের নাম রয়েছে। কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানও দখলদারের তালিকায় আছে। বিএস জরিপের ভিত্তিতে এ তালিকা করা হয়েছে। অন্য জরিপের ভিত্তিতে করলে কিছু কমবেশি হতে পারে।
সূত্র মতে, নগরীতে প্রধান খাল ১৬টি। এসব খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪৪ কিলোমিটার। প্রধান ১৬ খাল থেকে বের হয়েছে আরো কিছু শাখা খাল। সব মিলিয়ে নগরীতে এখন খালের সংখ্যা ৩৯। 
২০১৪ সালের ১৬ জুলাই নদী-সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের এক বৈঠকে চাক্তাই খালের সীমানা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। একই বছরের ২০ অক্টোবর সীমানা নির্ধারণ করে ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। কিন্তু সীমানা নির্ধারণে কেটে যায় প্রায় এক বছর।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে জমা দেয় চাক্তাই খাল সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত গঠিত কমিটি। তারপরও বহাল তবিয়তে আছেন অবৈধ দখলদাররা।
এ অবস্থায় চট্টগ্রাম নগরীর খাল দখলদারদের চিহ্নিত করতে উদ্যোগী হয় খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। খাল দখলের চিত্র জানতে চেয়ে গত বছরের ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে চিঠি দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক (প্রশাসন) ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ন কবীর সাক্ষরিত চিঠিতে চসিক ও জেলা প্রশাসনে আসে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর খালগুলো দখল করে প্রভাবশালী মহল অবৈধ স্থাপনা, ব্যবসা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করায় চট্টগ্রাম শহরে মারাত্মক জলাবদ্ধতা হচ্ছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে জনজীবন দুর্বিষহ অবস্থা বিরাজ করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মহানগরীর দখলকৃত খালগুলো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদসহ গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্যসহ একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন এ কার্যালয়ে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হলো।’
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন বলেন, সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আলোচনা করে খালের জায়গা থেকে অবৈধ দখলদারদের স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।
জীবন মুছা/এসএইচএস/এমএস