প্রযুক্তির ঢেউয়ে ডুবে যায় ডিভিডির সোনালি দিন

মামুনূর রহমান হৃদয়
মামুনূর রহমান হৃদয় মামুনূর রহমান হৃদয় , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০১:৩০ পিএম, ২৫ এপ্রিল ২০২৫

একটা সময় বিকালের অবসরে কিংবা ছুটির দিনে বাসার টেলিভিশনে সিডি চালিয়ে সিনেমা দেখাটা ছিল অনেকের কাছে এক ধরনের আনন্দময় রুটিন। শহরের অলিগলিতে ছিল অসংখ্য ভিডিও দোকান, যেখানে নতুন মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা বা বিদেশি গানের সিডি ভাড়ায় পাওয়া যেত। দোকানের সামনে সারি সারি সিডি ডিসপ্লে করে রাখা থাকত, সিনেমাপ্রেমীরা আগ্রহভরে দেখে পছন্দেরটি বেছে নিতেন। কেউ কেউ আবার প্রিয় সিনেমা বা গানের সিডি সংগ্রহ করে ঘরের তাক সাজাতেন। কিন্তু প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এসব দৃশ্য এখন শুধুই অতীত।

বর্তমান সময়ে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এবং ইন্টারনেট সংযোগের সহজলভ্যতার কারণে বিনোদনের মাধ্যমেও এসেছে বিপুল পরিবর্তন। এখন আর কেউ আলাদা করে সিডি বা ডিভিডি চালিয়ে গান বা সিনেমা দেখার ধৈর্য রাখে না। ইউটিউব, নেটফ্লিক্স, হইচই, অ্যামাজন প্রাইম কিংবা স্পটিফাইয়ের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এক ক্লিকে যে কোনো গান বা সিনেমা দেখা যায়। ফলে সিডি বা ডিভিডি প্লেয়ারের প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই পরিবর্তন যেমন সময়ের দাবি, তেমনি পুরোনো দিনের সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার অনুভূতিও এনে দেয়।

এক সময় যারা ভিডিও দোকান চালাতেন, তাদের অনেকেই এখন অন্য ব্যবসায় চলে গেছেন। কিছু দোকান ভেঙে মোবাইল কভার, চার্জার কিংবা ইলেকট্রনিক এক্সেসরিজের দোকানে রূপ নিয়েছে। কেউ কেউ প্লাস্টিকের বাক্সে ফেলে রেখেছেন অবিক্রিত সিডি, যেগুলো এখন কেবল ধুলা জমার পাত্র। বাসাবাড়িতেও ডিভিডি প্লেয়ার এখন ধুলিমাখা এক যন্ত্র, যার তারগুলো খুলে রাখা হয়েছে স্টোররুমে। এমনকি নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেই না যে কীভাবে সিডি চালাতে হয়, বা কীভাবে একসময় মানুষ ভিডিও টেপ রিওয়াইন্ড করে সিনেমা দেখত।

প্রযুক্তির উন্নয়নে মানুষের চাহিদা বদলেছে, সেই সঙ্গে বিনোদন গ্রহণের ধরণও। এখন গান শোনার জন্য কেউ সিডি কেনে না, বরং ফোনেই স্পটিফাই, গানা বা ইউটিউব অ্যাপে শুনে নেয় প্রিয় গান। সিনেমা দেখার জন্যও সাবস্ক্রিপশনভিত্তিক ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোই প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। এখানে যেমন সাশ্রয়ী মূল্যে অসংখ্য কনটেন্ট দেখা যায়, তেমনি প্রয়োজনে যে কোনো জায়গা থেকে, যে কোনো সময় উপভোগ করা যায়। এ সুবিধা ডিভিডি বা সিডির ক্ষেত্রে পাওয়া যেত না।

ডিভিডি ও সিডির বিলুপ্তি শুধু একটি প্রযুক্তির পতন নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। সিডি চালিয়ে সিনেমা দেখার সময় যে ধৈর্য, সেই সঙ্গে পুরো পরিবার মিলে টিভির সামনে বসে থাকার যে আন্তরিকতা ছিল, তা এখন আর নেই। এখন সবাই নিজের ফোনে নিজের মতো করে কনটেন্ট উপভোগ করে। এতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়তো বেড়েছে, কিন্তু পারিবারিক বিনোদনের জায়গাটা কিছুটা সংকুচিত হয়ে গেছে।

তবে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এ কথা বলাও ঠিক নয়। এখনো কিছু সংগ্রাহক বা ‘কালেক্টর’ আছেন, যারা পুরোনো সিনেমা বা মিউজিক অ্যালবামের অরিজিনাল সিডি যত্ন করে রাখেন। পুরোনো দিনের নস্টালজিয়ায় যারা ভোগেন, তাদের কাছে এসব ডিভাইসের গুরুত্ব অপরিসীম। তারা মনে করেন, একটানা ইন্টারনেট না থাকলেও ডিভিডি চালিয়ে মুভি দেখা যেত, যা বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর যুগে প্রায় অসম্ভব।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ডিভিডি ও সিডির দিন ফুরিয়ে এলেও তার ইতিহাস, স্মৃতি আর আবেগ থেকে যাবে বহুদিন। এই মাধ্যমগুলো আমাদের এক সময়ের বিনোদনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে গিয়ে আমরা হয়তো আরও আধুনিক হয়েছি, কিন্তু কিছু কিছু প্রযুক্তির হারিয়ে যাওয়া যেন আমাদের জীবনের একটি অধ্যায় সমাপ্ত হওয়ার মতো।

আরও পড়ুন

কেএসকে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।