সাজেক ভ্যালিতে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

মামুনূর রহমান হৃদয়
মামুনূর রহমান হৃদয় মামুনূর রহমান হৃদয় , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০৪:০৫ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী সাজেক ভ্যালির চূড়া থেকে পাখির চোখে সাদা মেঘ দেখা ভোরটি খালেকের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো দিন। এখানে মেঘময় পাহাড়ি লোকালয় আর পশ্চিম আকাশে মেঘের আড়ালে সূর্যাস্তের বিরল রূপ দেখে যে কেউ মুগ্ধ হবেন।

যতদূর চোখ পড়ে উপত্যকা পেরিয়ে সারি সারি আকাশচুম্বী পাহাড়ের ভাঁজ। আর এই দীর্ঘ উপত্যকার সবটাই অরণ্যে ঘেরা। এছাড়া রাত হতেই পাহাড়ের চারপাশ জুড়ে সুনসান নীরবতা।

আরও পড়ুন: কম খরচে কীভাবে ঘুরবেন পান্থুমাই জলপ্রপাতে?

সাজেক ভ্যালিতে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

দূর থেকে ছুটে আসে মৌসুমি হাওয়া। তারা-নক্ষত্রে ভরা সাজেকের রাতের আকাশ, মিটিমিটি আলোয় জ্বল জ্বল করে তারা আর চাঁদ। তখন অনেকদিনের চেনা রাতকেও নতুন রূপ দেখে অচেনা লাগে।

বাংলাদেশে এত সৌন্দর্য রয়েছে, যা এতদিন খালেকের খোলা দৃষ্টির বাইরে ছিল। যতবার ভেবেছে ততবার আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন এত সুন্দর প্রকৃতি দু’চোখ ভরে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে।

কিছুদিন থেকেই খালেক ভাবছিলেন কোথায় গেলে শূন্যতার মাঝে মনকে শান্ত করা যায়। তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হঠাৎ একদিন জানালেন সাজেক ঘুরতে যাবেন। কোনো কিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যায় খালেক। কল্যাণপুর থেকে শ্যামলী পরিবহনের বাসে রাত ১০টার গাড়িতে ৫ জনের একটা দল নিয়ে সাজেকের উদ্দেশে রওয়ানা হন।

আরও পড়ুন: ১৮ ঘণ্টা পানির নিচে থাকে যেই দ্বীপ

সাজেক ভ্যালিতে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

গল্প-আড্ডা আর গানে কাটতে লাগলো রাতের প্রহর। ভোরের আলোয় ফুটে উঠতেই আশেপাশে দেখা মিললো পাহাড়ের বিশালতা। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে কখনো ধীরে কখনো তীব্র গতিতে ছুটে সকাল ৭টায় দিঘীনালা পৌঁছে দিলো বাস। এখান থেকেই চাঁদের গাড়ি ভাড়া করতে হবে।

ডাল আর পরোটা দিয়ে সকালের নাশতা সেরে সকলে যখন চাঁদের গাড়ির জন্যে অপেক্ষারত তখন পাশের স্থানীয় বাজার থেকে কিছুটা হেঁটে আসার উদ্দেশ্যে সবাই পা বাড়ায়। রাস্তার ধারে ছোট একটি বাজারে নাম না জানা কিছু পাহাড়ি সবজি ছাড়া খুব বেশি কিছু ছিললো না কেনার মতো।

এদিকে চাঁদের গাড়ির সময় কাছে চলে আসায় খালেকরা আর দেড়ি করে গাড়ির স্ট্যান্ডে ফিরে আসে। চাঁদের গাড়িতে রওনা হতেই সকলের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেলো যেনো এক শীতল খুশির অনুভূতি।

আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন সিলেটের সবুজ পাহাড়ের পাশে শাপলার রাজ্যে

সাজেক ভ্যালিতে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

যত দামী গাড়ি হোক ইঞ্জিন পাওয়ার থাকে সাধারণত পেছনের দুই চাকায়, কিন্তু চার চাকায়ই ইঞ্জিন পাওয়ার বিশিষ্ট পাহাড়ি রাস্তায় চলার একমাত্র বাহনটি যখন পাহাড়ের পর পাহাড় পার হচ্ছিল তখন মনে হচ্ছিল যেনো উড়ে উড়ে এগিয়ে চলেছে অসীমের দ্বারে।

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার দু’ধারেই গিরিখাত। কিছুক্ষণের জন্যে নিজেকে পাখিই ভেবে নিয়েছিলো সবাই। তার উপর রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্থানীয় বাচ্চারা যখন হাত নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছিলো, তখন খালেকদের কাছে নিজেদের অতিথি বলে মনে হচ্ছিলো। এ যেনো এক নতুন অনুভূতি।

এরপর দুপুরবেলা সবাই ১৮০০ ফুট উচ্চতার পাহাড়ের চূড়া সাজেকে পৌঁছায়। সেখানে উঠে তাদের চোখে পড়লো রাস্তার দুপাশে গড়ে ওঠা নানা হোটেল। খালেকদের হোটেলটি ঢাকা থেকে আসার সময় অনলাইনে বুকিং করে রাখায় খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।

আরও পড়ুন: একদিনেই ঘুরে আসুন মিরসরাইয়ের বোয়ালিয়া ঝরনায়

সাজেক ভ্যালিতে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

হোটেলে প্রবেশপথ বারান্দা হয়ে। রুমের পেছন দিকে হওয়ায় ঝুলন্ত বারান্দা থেকেই দূরের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিলো। বিশ্রাম নিতে যে রুমে ঢুকবে তা ভুলে গিয়ে সবাই দাঁড়িয়ে উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো।

এরপর নির্ধারিত রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবাই চলে গেল দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে। দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় সবার চোখ কিছুটা কপালেই উঠে গেলো। পাহাড়ি বাঁশের সবজি, ব্যাম্বু চিকেন, পাহাড়ি আলু ভর্তা আর ডালের সঙ্গে সাদা ভাত।

মজার খাবার দেখে সাধারণত যততুকু খায় সেদিন দুপুরে তার চেয়ে বেশিই খেয়েছেন সবাই। খাওয়া শেষে চা খেতে গিয়ে খালেক দেখল এখানেও বাঁশের সুনিপুণ কারিগরি। বাঁশের তৈরি কাপেই খেতে হবে চা। বেশ আগ্রহ নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে এর স্বাদের কাছে সবাই নিজেকে সপে দিল।

আরও পড়ুন: ১০ বছরে ৫০ দেশ ভ্রমণের ইচ্ছে পারভেজের

সাজেক ভ্যালিতে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

মনোরম পরিবেশে দুপুরের বিশ্রাম শেষে বিকেলে সকলে কাছেই একটি অস্থায়ী বাজারে গেল। যেখানে নানা পন্যের পসরা সজিয়ে বসেছে পাহাড়িরা। সাজেকে ঘুরতে এসে সবাই নিজেদের মতো করে সময় বাজারটা ঘুরলেন।

খালেকও তাদের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেললা। বন্ধুদের গানের তালে তালে ও সুরে সুর মেলানোর চেষ্টা করলো খালেক। পুরো সন্ধ্যাটা সেখানেই কাঁটলো সবার। রাতের খাবারে ছিলো ব্যাম্বো মাটন বিরিয়ানি। যা এখানকার বিখ্যাত খাবার।

এখানেও সেই বাঁশের সুনিপুণ ব্যবহার। আগুনের অনিয়ন্ত্রিত তাপে বাঁশের ভেতরেই সেদ্ধ হয় মুরগির মাংসের বিরিয়ানি। যা এখনো সবার মুখে লেগে আছে। খাওয়া শেষে সবাই রাতের সৌন্দর্য দেখতে হেলিপ্যাডের কাছাকাছি একটি জায়গায় গেল।

আরও পড়ুন: ঘুরে আসুন দেশের সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম ‘মুনলাই’ থেকে

সাজেক ভ্যালিতে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

যেখানে বেঞ্চের ধারেই খাড়া পাহাড়। পূর্ণিমার আলোয় আলোকিত ছিল পুরো উপত্যকা। পরদিন ভোর পাঁচটায় উঠতে হবে তাই আর বেশি রাত পর্যন্ত রাতের মুগ্ধতা নেয়ার সুযোগ ছিল না সবার।

পরদিন ভোরে যখন ঘুম ভাঙলো জানালা দিয়ে বাইরে খালেকের চোখ গেলো। রাতের অন্ধকার তখন ঘুঁচে গেছে। যেভাবে ড্রয়িং করার সময় পেনসিলে এঁকে এরপর রং করা হয় তেমনি মনে হচ্ছে।

মিষ্টি বাতাসের সঙ্গে খালি চোখে মেঘের ভেলা দেখে আর বিছানায় থাকতে পারেনি সে, উঠে বারান্দায় গেলো। পুরো আকাশ ছেয়ে গেছে লাল আভায়। পাহাড়, মেঘের ওপর এমন লাল আভা চমৎকার সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছিল, মনে হচ্ছিল যেন কোনো দক্ষ শিল্পীর রং-তুলির আঁকা চিত্রকর্ম।

আরও পড়ুন: যে দেশের পুরুষরা ‘বউ বাজার’ থেকে টাকা দিয়ে কেনেন বউ

সাজেক ভ্যালিতে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

সবাই তৈরি হয়ে রওনা করলো কংলাক পাড়ার দিকে। গতকালের সেই আঁকাবাঁকা জরাজীর্ণ পাহাড়ি পথে ছুটলো তাদের চাঁদের গাড়ি। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সাদা তুলোর মতো মেঘ।

ছোট ফুটপাতের পরিচ্ছন্ন সাজেকের প্রথমে রুলুইপাড়া। সবাই রাতে যেখানে ছিল সেটাই রুলুইপাড়া। আর শেষ মাথায় কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় কংলাকপাড়া। দুই পাড়ার মধ্যে ৩০-৪০ মিনিট হাঁটার দূরত্বের কিছুটা পাকা রাস্তা আর কিছুটা মেঠোপথ।

পাহাড়ের সরল মনের আদিবাসীদের দৈনন্দিন জীবন থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। লুসাই, পাংকুয়া ও ত্রিপুরাদের সংস্কৃতি অনেক কিছু শেখার সুযোগ করে দিবে।

আরও পড়ুন: অপরূপ সৌন্দর্যের আরেক নাম বাওয়াছড়া

সাজেক ভ্যালিতে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

কংলাক পাড়া থেকে ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়। সাজেকের পূর্বে ভারতের মিজোরাম, উত্তরে ত্রিপুরা রাজ্য। পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু।

এই কংলাকের চূড়ায় না উঠলে সাজেক ভ্যালি ভ্রমণ বৃথা। এখান থেকে সবুজ পাহাড় ও মেঘের সমুদ্র দেখে খালেকের মনে হচ্ছিল সুবিশাল চূড়ায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ভালোবাসায় নিজেকে বেধে ফেলছে।

কংলাক পাহাড় থেকে নামতে নামতে বিদায়ের ঘণ্টা বেজে গেলো। ফেরার পথে সকালের পাহাড়ি মজাদার নাশতা শেষ করে সবাই ফিরে চললো হোটেলে। এভাবেই পাহাড়-মেঘ ও পাহাড়ি মানুষের সাথে কেটে গেলো তিনটি দিন।

সাজেক ভ্যালিতে কীভাবে যাবেন ও কী কী দেখবেন?

আরও পড়ুন: এ সময় শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে কী দেখবেন, কোথায় থাকবেন?

এরপর সবাই সাজেককে পেছনে ফেলে ভোরবেলা রওনা দিলো যান্ত্রিক শহর ঢাকার পথে। তবে পাহাড়ি আদিবাসীদের বাঁশের তৈরি আসবাবপত্রের ব্যবহার, তাদের জরাজীর্ণ ঘরবাড়ি আর শিশুদের পাহাড়ি রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে থেকে হাত নাড়ানোর দৃশ্য খালেকের মনে দাগ কেটে গেলো।

জেএমএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।