নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত বটগাছ ও ত্রিশাল

বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী পুরুষ, মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জীবনযাত্রা ছিল যেমন বর্ণময়, তেমনই সংগ্রামে ঘেরা। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে যেমন কবিতার ছন্দ, তেমনই সময়ের প্রতিধ্বনি। এ অসামান্য জীবনগাথার এক মর্মস্পর্শী অধ্যায় জড়িয়ে আছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল নামক এক নিভৃত জনপদের সঙ্গে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি প্রাচীন বটগাছ, যা নীরব অথচ জাগ্রত, যেন নজরুলের কিশোর বয়সের কথা মনে করিয়ে দিতে চায় প্রতিটি ছায়াঘন দুপুরে। এই বটগাছ শুধু প্রকৃতির অনুপম নিদর্শন নয়, এটি নজরুল স্মৃতির এক জীবন্ত ধারক। এখানেই তাঁর জীবনের এক নীরব, নিঃস্ব অথচ গভীর তাৎপর্যময় অধ্যায় অতিবাহিত হয়। দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা ও শিক্ষার টানাপোড়েনের মাঝেও নজরুল যে সাহস, স্বপ্ন আর সৃজনশীলতার বীজ বপন করেছিলেন, ত্রিশালের সেই মাটিতে তা আজও অনুভবযোগ্য।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে জন্মগ্রহণ করেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মাত্র নয় বছর বয়সে, ১৯০৮ সালে তিনি পিতৃহীন হন; তাঁর পিতা কাজী ফকির আহমদের ইন্তেকালের ফলে পরিবারে নেমে আসে চরম আর্থিক সংকট। এ সময় পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে। তবুও ১৯০৯ সালে প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মাত্র ১০ বছর বয়সে জীবিকার তাগিদে তিনি মক্তবে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং পাশাপাশি মসজিদ-মাজারে খেদমতের কাজেও যুক্ত হন।(১)
চাচা কাজী বজলে করিমের কাছে ফারসি শেখেন এবং তাঁর অনুপ্রেরণায় উর্দু-ফারসি মিশ্রিত মুসলমানি বাংলায় লেখালেখি শুরু করেন। লেটো দলে যোগ দিয়ে অল্প বয়সেই গীতিনাট্য, কবিগান ও প্রহসন রচনা করে ‘ছোট উস্তাদজি’ নামে পরিচিত হন। পরে লেটো দল ছেড়ে আসানসোল ইংরেজি হাইস্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু আবারও পড়ালেখা থেমে যায়। ভবঘুরে জীবনে গান রচনা ও পরিবেশন শুরু করেন। এক খ্রিষ্টান রেলগার্ড তাঁর গান শুনে চাকরি দিলেও তাতে বেশি দিন টিকতে পারেননি।
পরে নানা ঘোরাঘুরি শেষে তিনি আসানসোলের এক রুটির দোকানে এসে ওঠেন। রুটির দোকানে কাজ শেষে নজরুল রাত কাটাতেন আসানসোল থানার সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজউল্লাহর বাড়ির বারান্দায়। একদিন দারোগা সাহেব তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানলেন, ছেলেটি রুটির দোকানে কাজ করে ও থাকার জায়গা নেই। ‘কাজী’ উপাধি শুনে তিনি খুশি হন এবং স্ত্রী শামসুননেসার পরামর্শে নজরুলকে বাসায় কাজের জন্য রাখেন। নজরুল কাজের ফাঁকে পড়াশোনা ও গান গাইতেন। ছুটিতে গেলে দারোগা সাহেব তাঁকে সঙ্গে করে নিজগ্রাম ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাজীর সিমলায় নিয়ে যান।
রাঢ় দেশ থেকে এসে কাজীর সিমলার প্রকৃতি দেখে নজরুল মুগ্ধ হন। রফিজউল্লাহ দারোগা তাঁকে কাছাকাছি দরিরামপুর হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কাজীর সিমলায় কিছুদিনের মধ্যেই নজরুল স্থানীয় ঘাটু দলে যোগ দেন, যা সাধারণত গ্রাম্য অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লোকদের দিয়ে গঠিত হতো।
কাজীর সিমলা থেকে দরিরামপুর হাইস্কুলের দূরত্ব ও কষ্টকর যাতায়াতের কথা ভেবে দারোগা রফিজউল্লাহ নজরুলের থাকার ব্যবস্থা করতে চাইলেন। হেডমাস্টার বিপিনচন্দ্র চক্রবর্তীর পরামর্শে তিনি নজরুলকে ত্রিশাল নামাপাড়ায় আত্মীয় কাজী হামিদুল্লাহর বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে হামিদুল্লাহর মাধ্যমে যোগাযোগ হয় বিচুতিয়া বেপারীর সঙ্গে। দারোগা সাহেব নজরুলকে ভালো বংশের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দিয়ে তাঁর দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। বিচুতিয়া বেপারী আনন্দের সঙ্গে সম্মতি দেন এবং লেখাপড়ার যাবতীয় দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেন। বিদায় নেওয়ার আগে দারোগা সাহেব নজরুলকে ভালোভাবে পড়াশোনা ও আচরণের উপদেশ দিয়ে যান। প্রথম কয়েকদিন নজরুলের পরিচিতির পালাতেই কেটে গেল। অল্পদিনের মধ্যেই বিচুতিয়া বেপারীর বাড়ির সবাইকে নজরুল আপন করে নিলেন। বেপারী বাড়ির আশপাশে তাঁর কয়েকজন বন্ধুও জোটালেন।
বেপারী বাড়ির খুব কাছেই ছিল শুকনি বিল। আর বিলের পাড়ে ছিল গভীর জঙ্গল। সেখানে রয়েছে বিরাট এক বটগাছ। বটের ছায়ায় বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেন। বন্ধুদের বলতেন বটের ছায়া খুবই ভালো। গাছটি স্কুলে যাওয়ার পথে ছিল বলে নজরুল বটের শীতল ছায়ায় বিশ্রাম নিতেন। বন্ধুদের নিচে বসিয়ে নজরুল বটগাছে উঠে বাঁশি বাজাতেন। প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই নজরুল বাঁশি হাতে শুকনি পাড়ে চলে যেতেন। শুকনি পাড়ে বটগাছের নিচে বসে বাঁশি বাজাতেন।
এক বিকেলে নজরুল শুকনি পাড়ে গেলেন। দেখলেন, এক রাখাল বালক একটু উঁচু স্থানে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। বালকটির কাছে গিয়ে নজরুল বললেন, ‘তোমার বাঁশিটা আমাকে দাও।’ রাখাল দিতে অস্বীকার করলে নজরুল এক রকম জোর করে বাঁশিটা নিয়ে দৌড়ে বটগাছে উঠে বাজাতে শুরু করলেন। বাঁশির সুরে মাঠের কৃষক ও রাখাল বালকেরা বটতলায় ভিড় জমালো।
ত্রিশাল ছাড়ার কিছুদিন আগে এক রাতে জায়গির বাড়িতে নিচু স্বরে কাঁদছিলেন নজরুল। বিচুতিয়া বেপারী জিজ্ঞাসা করলে নজরুল জানান, মায়ের কথা মনে পড়ে কাঁদছেন। বেপারী সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, চাইলে বাড়ি ঘুরে আসতে পারেন, তিনি পথ খরচ দেবেন।পরদিন সকালে সাফরজান বানুও কান্নার কারণ জেনে পথ খরচ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিছুদিন পর দরিরামপুর হাইস্কুল থেকে ফিরে নজরুল জানান, তিনি চুরুলিয়া যাবেন। জায়গির বাড়ির লোকজন ভেবেছিলেন, মায়ের টানেই যাচ্ছেন। পরে শোনা যায়, স্কুলে একজন শিক্ষকের সঙ্গে নম্বর নিয়ে তাঁর কথা কাটাকাটি হয়েছিল, তবে কেউ তা গুরুতর মনে করেননি।
বিদায়ের দিন সকালে নজরুল পুকুরে গোসল করে ভাত খেতে বসেন। সাফরজান বানু কেঁদে ফেলেন, নজরুলের চোখেও পানি আসে। খাওয়া শেষে তিনি নজরুলের মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু টাকা দিয়ে বলেন, দূরের পথে দরকার হতে পারে—মায়ের সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসবে।
নজরুল যখন বিচুতিয়া বেপারীকে সালাম দিলেন, বেপারীর চোখে পানি এসে গেলো। তিনি নজরুলকে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, মায়ের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যাও। জায়গির বাড়ি থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সোলায়মান ও রুস্তমও ছিলেন। বিচুতিয়া বেপারীর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে নজরুল দরিরামপুর হাইস্কুলে গিয়ে এক ছাত্রকে একটি চিঠি হেডমাস্টারের কাছে দিতে বলেন। চিঠি পড়ে হেডমাস্টার বললেন, ‘আমার স্কুলের মুক্তা আজ চলে যাচ্ছে, ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।’
কিন্তু মুক্তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং এভাবেই নজরুল ত্রিশাল থেকে বিদায় নিয়ে আর ফিরে আসেননি। তবে ত্রিশালের মাটি, আকাশ আর সেই অদ্ভুত মায়া ছড়ানো বটগাছ যেন আজও সাক্ষ্য দেয় নজরুলের শৈশব সংগ্রামের, স্বপ্নের এবং সৃজনশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের। ত্রিশালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানুষের আন্তরিকতা এবং নিরিবিলি পরিবেশ নজরুলের সৃষ্টিশীল মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। শুকনি বিলে বাঁশি বাজানো হোক বা বটগাছের ছায়ায় বসে ভাবনার জগতে ভেসে যাওয়া—এসব অভিজ্ঞতা তাঁর কবিসত্তার ভিত নির্মাণে মুখ্য ছিল। ত্রিশাল তাই কেবল একটি স্থান নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলের আত্মপ্রতিষ্ঠার এক মৌলিক স্তম্ভ।
এসইউ/জিকেএস