জীবন যুদ্ধে জয়ী হুসনে আরা বেগম


প্রকাশিত: ০৩:০২ পিএম, ০৮ মার্চ ২০১৬

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়ার কারণে মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাল্য বিয়ের স্বীকার হন সিরাজগঞ্জের হুসনে আরা বেগম। কিন্তু তারপরও স্বামীর নির্যাতন একইসঙ্গে রক্ষণশীল সমাজের সাথে যুদ্ধ করে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন তিনি। শুধু নিজেকেই স্বাবলম্বী করেই থেমে থাকেননি। সমাজের নির্যাতিত নারীসহ দুস্থদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি সংগঠন। যা এখন তিল তিল করে অনেক দূর এগিয়েছে। সেই সঙ্গে নিজস্ব চেষ্টায় সন্তানদের গড়ে তুলেছেন নিজের মতো করে। জীবন সংগ্রামের পাশাপাশি নাচ, গান ও লেখালেখির মধ্যেও নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে কুড়িয়েছেন অসংখ্য সাধুবাদ আর পুরস্কার।

নারীদের নিয়ে গড়ে তোলা প্রোগ্রাম ফর উইমেন ডেভেলপমেন্ট এর প্রতিষ্ঠাতা হুসনে আরা বেগম। বাবা তৎকালীন বৃহত্তর পাবনা জেলা দায়রা জজের অধিনে একজন পেশকার ছিলেন। তিন ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।

হুসনে আরা বেগমের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৪ সালের ৭ এপ্রিল তার জন্ম। ছোট বেলা থেকেই মেধাবী থাকায় স্কুলের শিক্ষকসহ সকলের কাছে প্রিয় ছিলেন তিনি। লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ গানেও তিনি ছিলেন খুবই পারদর্শী। বাবার কাছেই লেখা পড়ার পাশাপাশি সংগীতে হাতে খড়ি। বাবার মুখে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কাহিনী শুনে বিভিন্ন ধরনের লেখালেখিতেও নিজেকে জড়িত করেন। ছোট বেলা থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি।

তিনি জানান, অসুস্থতার কারনে বাবাকে সে সময় মেয়াদের অনেক আগেই অবসর নিতে হয়। অস্বচ্ছলতায় পতিত হয় তাদের পরিবার। এরই মাঝে ১৯৭৭ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি বাল্য বিয়ের শিকার হন। স্বামী (স্বামীর পরিচয় জানাতে অনিচ্ছুক) একজন সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। একজন নাবালিকা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সংসার জীবনে পা রাখায় তার জীবনের সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয় নির্যাতন। নির্যাতন সহ্য করতে করতেই তাদের ঘরে আসে ২টি সন্তান।

স্বামী এক ভণ্ডপীরের পাল­্লায় পড়ে নানা ধরনের মাদক সেবনসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লে এই কষ্ট আরো অনেকগুন বেড়ে যায়। একদিকে স্বামীর নির্যাতন অপর দিকে সন্তানদের ভরণ পোষণ করতে না পারার কারণে বিয়ের ১৪ বছর পর ১৯৯১ সালে সন্তানদের নিয়ে তিনি বাবার বাড়িতে ফিরে আসেন।

এরপর থেকেই শুরু হয় বেঁচে থাকার জন্য দ্বিতীয় দফা সংগ্রাম। রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অত্যন্ত প্রতিকুল পরিবেশের মধ্য দিয়ে তিনি যুদ্ধ করতে থাকেন। অর্ধাহারে আর অনাহারে পিতার আশ্রয়ে দিন শুরু করেন তিনি। পিতার স্বল্প পেনশনের উপর ভরসা না করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ানোর পাশাপাশি গান শেখাতে শুরু করেন। অবসর সময়ে সেলাই করে যা রোজগার হতো তাই দিয়ে নিজের ও সন্তানের মুখের খাবারের যোগাড় হতে থাকে।

তার এই কাজ দেখে সেদিন সমাজের কিছু স্বার্থান্বেষীরা সমালোচনা করলেও তাকে সহযোগীতার হাত বাড়াননি কেউ। তবে এর কিছুদিন পর সমাজের কিছু উপকারী বন্ধুদের সহায়তায় তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে নাচের টিচার এবং উল্লাপাড়ায় হামিদা গার্লস স্কুলে গানের টিচার হিসাবে চাকরি নেন। এ ভাবেই দিন পার করছিলেন তিনি।

তবে জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত, টানাপোড়নের মধ্যে সমাজের লালসার হাত থেকে বাঁচতে পরিবারের সিদ্ধান্তে তিনি পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৯২ সালে। মাথার উপরে একটি ছায়া খুঁজে পান তিনি। স্বামীর ইচ্ছা ও নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তিনি আবার পড়ালেখা শুরু করেন। বিএ পাশ করার পর তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সুযোগ গ্রহণ করে নিজেকে দক্ষ করে তোলেন।

Sirajganj

চাকরির পাশাপাশি তিনি নির্যাতনের শিকার নারীদের নিয়ে ভাবতে থাকেন। নির্যাতনের শিকার নারীদের দুঃখ কষ্ট উপলব্ধি করে তিনি নির্যাতিতদের পাশে এসে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। নিজের চরম দূর্ভোগের সেই সব দিন গুলোর কথা মনে করে তিনি ভাবতে থাকেন বড় আকারে কিভাবে নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ানো যায়। যেখান থেকে তিনি অসহায় নারী ও শিশুদের জন্য কাজ করতে পারবেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি চাকরি ছেড়ে এলাকার নারীদের সংগঠিত করে ১৯৯৯ সালে প্রোগ্রাম ফর উইমেন ডেভেলপমেন্ট ( পিডাব্লিউডি) নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন।
 
সংগঠনে তিনি প্রাথমিক ভাবে প্রশিক্ষক হিসাবে এলাকার দুঃস্থ নারীদের একত্রিত করে বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজ শেখান। মুজুরী ভিত্তিতে তাদের দ্বারা উৎপাদিত পন্য বাজারে বিক্রী করে সংগঠন চালাতে থাকেন। নানা কর্মকাণ্ড সহ সরকারি/বেসরকারি  অনুদান এবং নিজের উপার্জিত অর্থের দ্বারা প্রতিষ্ঠানের তহবিল গঠন করেন। পরবর্তীতে তিনি দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএলও এবং ইউএনডিপিতে প্রশিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। সংগঠনের মূল কাজ গুলোর মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ, শিশু অধিকার, বিরঙ্গনা নারীদের জীবনমান উন্নয়নে সহযোগীতা, অবহেলিত দরিদ্র ও দুস্থ নারীদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, গ্রাম পর্যায়ে নারীদের সংগঠিত করে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দল গঠন ইত্যাদি।

অসহায় নারীদের আইনী সহযোগিতা দিতে এবং বিভিন্ন সেবা দানকারী সংস্থার সেবা দেয়াসহ বিভিন্ন আন্দোলন মূখী কর্মসূচির সাথে এই সংগঠনটি জড়িত। বর্তমানে এই সংগঠনটি কালেবরে অনেক বড় হয়েছে। এখন এই সংগঠনে মোট ১৭ জন নারী পুরুষ নিয়মিত এবং ৩০ জন নারী অনিয়মিত ভাবে নানা প্রকল্পে কর্মরত রয়েছেন। এই সংগঠন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক পর্যায়ে সুপরিচিত ও সুনাম অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার সাথে সংগঠনটি কাজ করছে।

আগের দুই সন্তান সহ এখন তার তিনটি সন্তান। যার মধ্যে একজন ছেলে ও ২জন মেয়ে। তার বড় মেয়ে ইডেন কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স শেষে বর্তমানে সোনালী ব্যাংক সিরাজগঞ্জে সিনিয়র অফিসার পদে কর্মরত রয়েছেন। ছেলে ঢাকা কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স মাস্টার্স শেষে কর্নকর্ড গ্রুপে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ এ্যাডমিন পদে কর্মরত রয়েছেন। সব ছোট মেয়ে চ্যানেল আই ক্ষুদে গানরাজ প্রতিযোগীয় টপ টেনে নিজের জায়গা করে নিয়ে সংগীত অঙ্গনে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। একই সাথে সে ঢাকায় ধানমন্ডিতে ভার্টিকাল হরিজন এর এ লেভেলে পড়ালেখা করছে।

দৃঢ় মনোবল অসম্ভব পরিশ্রম এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়েছেন বলেই আজ তিনি এখানে এসে দাঁড়াতে পেরেছেন।  কোন প্রতিকুল পরিবেশে তিনি মনোবল হারাননি। সংগঠন তৈরির পাশাপাশি তিনি এখনো লেখালেখির সাথে জড়িত রয়েছেন। এ পর্যন্ত তার ৮টি যৌথ কবিতা সংকলন ও একটি একক কবিতা সংকলন বিহঙ্গ বেলায় প্রকাশিত হয়েছে।

২০০৫ সালে কবিতা-সাহিত্যে লেখক সংঘ বগুড়া কর্তৃক রোমেনা আফাজ স্মৃতি স্মারক, ২০০৯ সালে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ শিশু একাডেমী সিরাজগঞ্জ শাখা কর্তৃক শুভেচ্ছা স্বারক প্রদান করা হয়েছে। ২০১৩ সালে জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ কার্যক্রমের আওতায় সমাজ উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় থেকে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা-২০১৩ নির্বাচিত হন তিনি। ২০১৪ সালে সফল নারী উদ্যোক্তা ও সমাজ উন্নয়নে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে এশিয়া হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন কর্তৃক মহাত্বা গান্ধী পিস এ্যাওয়ার্ড-২০১৪ প্রদান করা হয়। এ ছাড়াও আনন্দধারা নৃত্যকলা একাডেমী কর্তৃক তাকে সন্মাননা স্বারক-২০১৫ প্রদান করা হয়।

সবশেষ তিনি জানান, সমন্বিত বাজার ব্যাবস্থাপনার মাধ্যমে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছলসহ নিজস্ব মতামত প্রদানের একটি প্লাাটফর্ম তৈরি করাই হবে তার প্রধান লক্ষ্য। সেই নির্যাতনের ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠলেও আজও তিনি শিউরে ওঠেন। তবে সেই স্মৃতিগুলোকে শক্তিতে পরিণত করে আজ তিনি নির্যাতনের যারা শিকার তাদের সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি সবাইকে কিভাবে দুঃসময়গুলো পার করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে তাও তাদের শেখাচ্ছেন। অতিতের প্রতিটি পদক্ষেপের বাধা গুলোকে তিনি জীবনের সফলতার সিঁড়ি হিসাবে নিয়েছেন। এখনো অপেক্ষায় রয়েছেন সেই দিনের, যেদিন থেকে নারী সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারে ফিরে পাবে তার অধিকার। একই সাথে ফিরে পাবে  মর্যাদা, কাজের স্বীকৃতি এবং সহিংসতা মুক্ত নিরাপদ পরিবেশ।

এফএ/এমএএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।