পাহাড়ের আলো নিরূপা দেওয়ান
শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়াসহ সর্বোপরি সামাজিক ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডে জীবনভর নিরলস দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন নিরূপা দেওয়ান। বর্তমানে তিনি সারা দেশে মানুষের অধিকার রক্ষায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য পদের দায়িত্বে কাজ করে যাচ্ছেন।
আত্মনিবেদিত সমাজ কর্মের অবদানের ফলে সর্বশেষ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য পদে মূল্যায়িত হতে পেরেছেন এই দীপ্তিময় নারী ব্যক্তিত্ব নিরূপা দেওয়ান। অনন্য অবদানের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র নারী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় এবং সাংবিধানিক এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় স্থান পাওয়াকে তার বড় অর্জন বলে গর্ববোধ করেন পার্বত্যবাসী। তাই পাহাড়ের আলোর শিখা হয়ে জনস্বীকৃতি অর্জনেও সক্ষম হয়েছেন নিরূপা দেওয়ান।
চির কুমারী নিরূপা দেওয়ানের বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন থেকে জানা যায়, তিনি শিক্ষা জীবন থেকেই জড়িত ছিলেন স্বেচ্ছাসেবী ও গঠনমূলক নানা কাজে। রাঙামাটি শহরের পাথরঘাটা নিবাসী প্রয়াত প্রভাত চন্দ্র দেওয়ান ও সুপ্রভা দেওয়ানের গর্বিত মেয়ে নিরূপা দেওয়ানের জন্ম ১৯৫২ সালের ৩১ মার্চ। তিনি শিক্ষাজীবনে বিএএমএড পাস করে চার বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেছিলেন এবং সহকারী শিক্ষক হিসেবে ছিলেন দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৩০ বছর। রাঙামাটি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অবসরে যান তিনি।
শিক্ষকতার পাশাপাশি সামাজিক, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও স্বেচ্ছাসেবিমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থেকে দায়িত্ব পালন করেন বহু প্রতিষ্ঠানে।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে, ১ডিসেম্বর ১৯৯২-৯৬ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের সদস্য, ১৯৯২-৯৬ বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, ১৯৯৪-৯৬ চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য, ১৯৭৮ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত জেলা মহিলা সংস্থার সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচিত সদস্য ও চট্টগ্রামের অতিরিক্ত আঞ্চলিক কমিশনার, জেলা গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশনের জেলা কমিশনার, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও পরিবার পরিকল্পনা সমিতির আজীবন সদস্য, রোটারী ক্লাব অব রাঙ্গামাটি লেক সিটির প্রেসিডেন্ট, জেলা আইনশৃংখলা কমিটি ও রাঙ্গামাটি পৌরসভার নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য এবং জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের জেলা শাখার সভাপতি।
এছাড়াও তিনি যেসকল পুরস্কারগুলো পেয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বেতারে চট্টগ্রামের উপজাতীয় (চাকমা) গানের শিল্পী হিসেবে তালিকাভূক্ত হন তিনি। ১৯৮০ সালে শ্রেষ্ঠ গাইডার হিসেবে এবং ১৯৯৪ সালে গাইডিং আন্দোলনে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ গার্ল গাইডস অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক স্টার অব বাংলাদেশ পদক লাভ করেন। ২০০১ সালে গার্লস গাইডস শিক্ষিকা হিসেবে স্বর্ণ পদক পান।
২০১০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অবৈতনিক সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় নিরূপা দেওয়ানকে। ২০১১ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় ক্রীড়াঙ্গনে অনন্য অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন এবং একই সালে বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থা হতে সুলতানা কামাল স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
নিরূপা দেওয়ান ১৯৮০ সালে ভারতের পুনা, ১৯৮৫ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, ১৯৯১ সালে শ্রীলংকার কলম্বো এবং ১৯৯৮ সালে চীনের বেইজিং ও সাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব গার্ল গাইডস সংস্থার আন্তর্জাতিক সেমিনার ও অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। এছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য হিসেবে ভারত, ডেনমার্ক ও যুক্তরাজ্যে, সুইজারল্যান্ড, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ায় শিক্ষা সফরসহ বিভিন্ন সেমিনারে যোগদান করেন তিনি।
নিরূপা দেওয়ানের এসব কর্ম ও অর্জন নিয়ে রাঙামাটি প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে বলেন, দেশ, জাতি ও সমাজের কাছে নিরূপা দেওয়ানের অবদান অপরিসীম। তিনি পাহাড়ে শিক্ষা, ক্রীড়া, সংস্কৃতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তার অনুপ্রেরণায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী আজ দেশের গর্বিত নাগরিক হয়ে বিভিন্ন কর্ম ও পেশায় আত্ম-নিয়োজিত রয়েছেন। নিরূপা দেওয়ান পাহাড়ের একজন আলোর শিখা।
নিজেকে সফল ও ধন্য বলে মনে করে নিরূপা দেওয়ান বলেন, জীবনে দেশ, জাতি, সমাজ ও জনসেবার কাজের যেসব সুযোগ পেয়েছেন সেজন্য সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি কী ভূমিকা রাখতে পেরেছেন তার বাছ-বিচার ও মূল্যায়ন করবে জাতি ও সমাজ। তার কর্মে যদি কোনো অর্জন থেকে থাকে তা সম্ভব হয়েছে সবার সহায়তা ও সহমর্মিতায়। আমৃত্যু যদি দেশ, জাতি, সমাজ ও জনকল্যাণে কাজ করে যেতে পারেন সেটাই হবে তার পরম তৃপ্তি।
এফএ/এমএএস/পিআর