গণমাধ্যম

বছরজুড়ে সাংবাদিক নির্যাতন, দেশ-বিদেশে উদ্বেগ

২০২৫ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, মামলা, গ্রেফতার ও হত্যার ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। একই সঙ্গে সরাসরি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত এক বছরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্তত ৩৮১ জন সাংবাদিক বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় উভয় পক্ষের এই নিপীড়ন দেশের গণতান্ত্রিক পরিসর ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চরমভাবে সংকুচিত করেছে।

স্থানীয় তথ্যের পাশাপাশি ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’ (সিপিজে) ও ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’সহ (আরএসএফ) আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে।

পরিসংখ্যানে সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র

আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দেশে প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন সাংবাদিক এবং রহস্যজনকভাবে উদ্ধার করা হয়েছে আরও চারজনের মরদেহ। নির্যাতনের শিকার সাংবাদিকদের মধ্যে ১১৮ জন সরাসরি হামলার শিকার হয়েছেন এবং প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন ২০ জন।

এছাড়া প্রকাশিত সংবাদের জেরে মামলার মুখোমুখি হয়েছেন অন্তত ১২৩ জন সাংবাদিক।

ভৌগোলিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বোচ্চ নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ঢাকা জেলায় ৯২ জন। এরপর চট্টগ্রামে ৫৩ জন, গাজীপুর ও রংপুরে ২১ জন করে এবং বরিশালে ১২ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

আইনি নিপীড়ন ও আলোচিত গ্রেফতার

প্রতিবেদনে চলতি বছরে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন’ ব্যবহারের একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে প্রবীণ সাংবাদিক আনিস আলমগীরের গ্রেফতার ও রিমান্ডের ঘটনাটি দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টকশোতে সরকারের সমালোচনা করার পর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা তাকে আটক করে এবং ‘আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনার প্রোপাগান্ডা’ চালানোর অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনার আমলে অন্তত ৭০ সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছেক্ষমতায় গেলে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনার বিচার নিশ্চিত করবে জামায়াতসাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনায় ডিআরইউয়ের উদ্বেগ

একইভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদকে সেপ্টেম্বর মাসের একটি নাশকতার মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে, যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন অনেকে।

মব ভায়োলেন্স ও চাকরিচ্যুতি

গণমাধ্যমের ওপর প্রভাব বিস্তারে এ বছর ‘মব কালচার’ বা দলবদ্ধ চাপের অপপ্রয়োগ দেখা গেছে। গত ২৮ এপ্রিল সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করাকে কেন্দ্র করে ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিন টেলিভিশন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক প্রচার চালানো হয়। ‘মার্চ টু অফিস’ কর্মসূচির হুমকির মুখে দীপ্ত টিভি, চ্যানেল আই এবং এটিএন বাংলার তিন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করতে বাধ্য করা হয়।

এছাড়া জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীসময়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় ৩২টি ফৌজদারি মামলায় অন্তত ১৩৭ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনেও মামলা দেওয়া হয়েছে।

আসকের পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপদেষ্টা মাবরুক মোহাম্মদ জাগো নিউজকে বলেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে মব ভায়োলেন্স বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। ২০২৪ সাল থেকে সাংবাদিক নির্যাতনের সংখ্যা ও ধরন নজিরবিহীনভাবে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এই সংকট নিরসনে সাংবাদিক নির্যাতনকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে গণ্য করে দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা পর্যবেক্ষণে সরকারি কমিটি গঠিত হওয়া সত্ত্বেও আইনি নিপীড়ন থামেনি। এটি একটি কাঠামোগত নিপীড়নের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক শাসনের জন্য সরাসরি হুমকি। দেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি মজবুত করতে হলে ভিন্নমতের প্রতি রাষ্ট্রের সহনশীলতা এবং সাংবাদিকদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি।

২০২৫ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, নির্যাতন, গ্রেফতার এবং হত্যার ঘটনা স্থানীয় সংস্থাটির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোরও নজরে এসেছে। সিপিজে ও আরএসএফ তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাংলাদেশের সাংবাদিকরা ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছেন।

সিপিজের প্রতিবেদনের প্রধান বিষয়

কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ তারিখে ‘বাংলাদেশে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়েছে, প্রবীণ সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে। কমিটি এ ঘটনায় সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

আরও পড়ুনসাগর-রুনিসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার দাবি সিএমইউজেরসাংবাদিক হত্যায় শাস্তি হয় না, এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে: টিআইবিসাংবাদিকদের ওপর হামলা-সহিংসতা বেড়েছে, কমেছে মামলা-গ্রেফতারগণহত্যায় উসকানি: ২৯ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ

প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অন্তত ১৭ জন সাংবাদিক হামলার শিকার হয়েছেন, যা শারীরিক নির্যাতন ও পেশাগত বাধার অন্তর্ভুক্ত।

আরএসএফের প্রতিবেদনের তথ্য

আরএসএফ তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ২০২৫ সালের ১ আগস্ট ‘মনসুন বিপ্লবের এক বছর পর: ছয়জন নিহত সাংবাদিকের ন্যায়বিচার এখনও দূর’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিহত সাংবাদিকদের বিচার না হওয়াকে তুলে ধরা হয়েছে।

সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে অন্তত একজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এবং পাঁচজন সাংবাদিক বর্তমানে আটক বা বিচারাধীন অবস্থায়। সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, এই পরিস্থিতি আগের বছরের সহিংসতা ও বিচারহীনতার ধারাবাহিক ফল।

আরএসএফের প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নিহত ছয়জন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যাদের পরিবার এখনো বিচার পাননি। তারা হলেন- শাকিল হোসেন, মেহেদি হাসান, আবু তাহের মোহাম্মদ তুরাব, তাহির জামান প্রিয়ো, প্রদীপ কুমার ভৌমিক ও সোহেল আখঞ্জি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশ গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন এবং একজন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। এক বছর পেরিয়ে গেলেও এসব হত্যাকাণ্ডের কার্যকর বিচার হয়নি।

সংস্থাগুলোর আহ্বান

সিপিজে, আরএসএফ ও আসক একযোগে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, হামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা তদন্ত করতে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বজায় রাখতে। সংস্থাগুলোর মতে, এ ধরনের পদক্ষেপ ব্যতীত সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ ঝুঁকিপূর্ণ থেকে যাবে।

২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রতিবেদনের সংমিশ্রণে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ ক্রমেই বিপদের মুখে রয়েছে। নিহত ও আটক সাংবাদিকদের সংখ্যা উদ্বেগজনক এবং স্থানীয় পর্যবেক্ষণের তথ্য সাংবাদিক নির্যাতনের বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরে।

আসকের উপদেষ্টা মাবরুক মোহাম্মদ সাংবাদিক নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যানে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সাংবাদিকদের ওপর হামলার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

আসকের তথ্যমতে, ২০২২ সালে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ছিল ২২৬টি, যা নির্বাচনের বছর ২০২৩-এ বেড়ে দাঁড়ায় ২৯২টিতে। ২০২৪ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় এটি রেকর্ড ৫৩১টিতে পৌঁছায়। ২০২৫ সালে ৩৮১টি ঘটনা ঘটলেও এর ধরন বদলেছে।

মাবরুক মোহাম্মদ বলেন, ‘এখন শুধু ব্যক্তি সাংবাদিক নন, সরাসরি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো আক্রান্ত হচ্ছে, যা নজিরবিহীন।’

আরও পড়ুনকুষ্টিয়ায় সাংবাদিকের ওপর সন্ত্রাসী হামলা, ওসি প্রত্যাহারবিচার না হওয়ায় সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনা ঘটেএক দশকে খুন-গুম-অপহৃত ৩০ সাংবাদিক, মেলে না বিচার২০২৩ সালে ২৯০ সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার: আসক

তিনি উল্লেখ করেন, অতীতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চললেও এখন ‘ট্যাগিং’ বা তকমা দেওয়ার রাজনীতি শুরু হয়েছে। সাংবাদিকরা কার দোসর বা কোন বলয়ের—এমন যোগসূত্র খুঁজে তাদের ওপর হামলা হচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে এবং প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে অন্য গণমাধ্যমগুলোকে একটি ভীতিজনক বার্তা দেওয়া হচ্ছে, যা স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রধান বাধা।

মাবরুক মোহাম্মদের মতে, বর্তমান সরকার সমালোচনার সুযোগ দেওয়ার কথা বললেও নীতি প্রয়োগে তাদের দুর্বলতা স্পষ্ট। ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগে এক ধরনের ‘মব ভায়োলেন্স’ চালিয়ে গণমাধ্যম বন্ধের যে প্রবণতা তৈরি হয়েছে, তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অশনিসংকেত।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রাইসুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতন এখন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এক ভয়াবহ স্বাভাবিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। যেখানে হামলা, হুমকি ও মিথ্যা মামলার মাধ্যমে সত্য প্রকাশকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হচ্ছে। এ সংকটের মূলে রয়েছে দণ্ডহীনতার সংস্কৃতি। কারণ অপরাধীরা জানে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়েও তারা পার পেয়ে যাবে।

এর কার্যকর সমাধানে সাংবাদিক নির্যাতনকে স্বতন্ত্র ও গুরুতর অপরাধ হিসেবে আইনে সংজ্ঞায়িত করে দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান রাইসুল ইসলাম, অন্যথায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেবল সংবিধানের পাতায়ই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে তিনি সতর্ক করেন।

এমডিএএ/এমএমএআর/এমএফএ/এমএস