সরিষায় নতুন স্বপ্ন দেখছেন পাবনার কৃষকেরা
শীত মৌসুমে পাবনার ৯টি উপজেলায় বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন শোভা পাচ্ছে হলুদ সরিষা ফুল। হলুদের চাদরে মোড়ানো এমন অপরূপ দৃশ্য দেখতে ফসলের মাঠে ভিড় করছেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। প্রতি বছরই শীতের এ সময়টাতে পাবনার বিভিন্ন ফসলের মাঠে সৌন্দর্যের এক নতুন বার্তা নিয়ে আসে হলুদ সরিষা ফুল। পাশাপাশি শীতের হিমেল হাওয়ায় দোল খাওয়া হলুদ ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন তো আছেই। কাঁচা হলুদের মৌ মৌ গন্ধ আর মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। প্রতি বছরই ভালো ফলন আর দাম পেয়ে খুশি কৃষকেরাও। পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিতেও ফেলছে ইতিবাচক প্রভাব। আবহাওয়া অনূকূলে থাকলে এ বছরও ভালো ফলনের আশা কৃষকের।
কৃষকেরা জানান, বিগত বছরে ভালো ফলন ও দাম পাওয়ায় এ বছরেও অনেক জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন তারা। চলতি মৌসুমে ফসলের ভালো ফলন আসতে দেখে হাসি ফুটছে কৃষকের মুখে। আবহাওয়া অনূকূল ও কোনো প্রকার রোগবালাই বা পোকামাকড়ের আক্রমণ না হলে এ বছরও ভালো ফলন আর দামের আশা তাদের।
কৃষকেরা আরও জানান, উচ্চ ফলনশীল জাতের সরিষা বপনের মাত্র ৫৫-৬০ দিনের মধ্যে ফলন পাওয়া যায়। আমন ধান কেটে জমিতে বীজ ছড়িয়ে দিলেই সরিষা হয়ে যায়। তেমন সেচের প্রয়োজন হয় না। এ ছাড়া সরিষা উঠিয়ে বোরো আবাদের মৌসুমও ধরা যায়। এ জন্য সরিষা আবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন তারা। সরিষা পাতা মাটিতে ঝরে জৈব সারের কাজ করে এবং জমির উর্বরতা বাড়ায়। সরিষা আবাদের পর জমিতে বোরো ধান আবাদে সারের পরিমাণ অনেকটা কম লাগে। ফলে ধান চাষের খরচ অনেকটা কমে যায়। বাজারে ভালো দাম থাকায় কৃষকেরা বেশ লাভবান হন।
চলনবিল অধ্যুষিত চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া উপজেলার দিলপাশার ও সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার মাঠগুলো ঘুরে দেখা যায়, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর কিংবা সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, উল্লাপাড়াসহ পুরো চলনবিলজুড়ে এখন নয়নাভিরাম হলুদ ফুলের সাজ। এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন ভ্রমণপিপাসুরা। শুধু চলনবিলই নয়; পাবনা জেলাজুড়েই এখন হলুদ সরিষা ফুলে ভরে আছে কৃষকের মাঠ। ফুলের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে, সবুজ সরিষার শীষ। কম খরচ আর পরিশ্রমে লাভবান হওয়ায় খুশি চাষিরা।

চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল পাইকপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুর রহিম বলেন, ‘এ মৌসুমে ৪ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছি। সার, বীজ, কীটনাশক ও সেচসহ ১ বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে প্রায় ৯ হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে বিঘাপ্রতি ৬-৭ মণ সরিষা হয়। বাজারে ভালো দাম পেলে ১ মণ সরিষা ২৮০০-৩০০০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়। সবমিলিয়ে কম ব্যয় ও পরিশ্রমে সরিষা আবাদ লাভজনক।’
সদর উপজেলার চর সদিরাজপুরের কৃষক হাসান বলেন, ‘চর ও বিলের মাটিতে সরিষা ভালো হয়। এ বছর ৩ বিঘা জমিতে সরিষা বুনেছি। ফুল ও গাছ ভালো হয়েছে। কোনো দুর্যোগ না হলে ফলন ভালো হবে।’
আরও পড়ুন
১৮ কাঠায় ২৬ সবজি, মেহেরপুরে কৃষক আবুল কালামের অনন্য সাফল্য
মিরসরাইয়ের ১২০০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ
এদিকে সরিষার পাশাপাশি ক্ষেতে মধু চাষেও আগ্রহ বাড়ছে মৌ চাষিদের। গুণগত মান ভালো হওয়ায় মিলছে ভালো দাম। দেশের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত মধু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। আধুনিক পদ্ধতিতে মৌবাক্সে পালিত মৌমাছির মাধ্যমে মধু সংগ্রহে গত কয়েক বছরে অনেকে হয়েছেন স্বাবলম্বী। এ ছাড়া মৌমাছির আনাগোনা ও পরাগায়নেও বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলন।
ভাঙ্গুড়ার অষ্টমনীষা গ্রামে সাতক্ষীরার কালিগঙ্গা থেকে মধু সংগ্রহ করতে আসা মৌচাষি নয়ন বলেন, ‘সরিষার মৌসুমে আমরা ক্ষেতের পাশে বাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করি। প্রতি কেজি মধু ৪০০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি করি। বাজারে এগুলো বেশি দামেও বিক্রি হয়। সরিষা ফুলে মৌমাছি বসলে ফলন বাড়ে। তাই চাষিরাও আমাদের সহযোগিতা করে। এ মৌসুমে ৫৩টি মৌবাক্স থেকে ১ হাজার ৫৯০ কেজি মধু সংগ্রহ করা যাবে।’

কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, চলতি মৌসুমে ৪৯ হাজর ৮২ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর বিপরীতে এখন পর্যন্ত আবাদ হয়েছে ৪২ হাজার ৫৪৫ হেক্টর। চলতি মৌসুমে কৃষক তার জমিতে উচ্চ ফলনশীল বারি-১৪, বারি-১৫, বারি-১৮ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা বেশি আবাদ করছে। এ ছাড়া এ বছরে সরিষা ক্ষেতে মৌবক্স স্থাপনের মাধ্যমে ১১০ মেট্রিক টন মধু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। উৎপাদিত এসব মধু স্থানীয় ক্রেতার পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রামাণিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমদানিনির্ভর ভোজ্যতেলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ওষুধিগুণ সম্পন্ন সরিষা তেলের চাহিদা বাড়ায় গত কয়েক বছর ধরে বেশ লাভবান হচ্ছেন কৃষক। সেইসঙ্গে তেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে এবং সরিষার চাষাবাদ বাড়াতে কৃষকদের সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সামনের দিনে সরিষার চাষাবাদ আরও সম্প্রসারিত করা হবে। এতে কৃষকেরা আরও লাভবান হবেন।’
তিনি বলেন, ‘সরিষা ক্ষেতে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌবাক্সে পালিত মৌমাছির মাধ্যমে মধু সংগ্রহে অনেক মৌচাষি স্বাবলম্বী হচ্ছেন। কৃষি বিভাগের তালিকাভুক্ত খামারিসহ অনেক মৌ-খামারি এখন মাঠে মধু সংগ্রহে কাজ করছেন।’
আলমগীর হোসাইন নাবিল/এসইউ/এমএস