সুকুমার রায়ের মজার গল্প: উকিলের বুদ্ধি

গরিব চাষার নামে আদালতে এক মহাজন নালিশ করেছে। বেচারা কবে তার কাছে পঁচিশ টাকা নিয়েছিল, সুদে আসলে তাই এখন ৫০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। চাষা অনেক কষ্টে ১০০ টাকা যোগাড় করেছে; কিন্তু মহাজন বলছে, ‘পাঁচশো টাকার এক পয়সাও কম নয়; দিতে না পার তো জেলে যাও।’ সুতরাং চাষার আর রক্ষা নাই।
এমন সময় চশমা চোখে তোখোড় বুদ্ধির উকিল এসে বললো, ‘ঐ ১০০ টাকা আমায় দিলে, তোমার বাঁচবার উপায় করতে পারি।’ চাষা তার হাতে ধরল, পায়ে ধরল, তারপর বললো, ‘আমায় বাঁচিয়ে দিন।’
উকিল বললো, ‘তবে শোন, আমার ফন্দি বলি। যখন আদালতের কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়াবে, তখন বাপু হে কথা বলো না। যে যা খুশি বলুক, গাল দিক আর প্রশ্ন করুক, তুমি তার জবাব দেবে না। খালি পাঁঠার মতো ‘ব্যা’ করবে। তা যদি করতে পার, তাহলে আমি তোমায় খালাস করিয়ে দেব। চাষা বললো, ‘আপনি কর্তা যা বলেন, তাতেই আমি রাজী।’
আদালতে মহাজনের মস্ত উকিল, চাষাকে এক ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি সাত বছর আগে পঁচিশ টাকা কর্জ নিয়েছিলে?’ চাষা তার মুখের দিকে চেয়ে বললো, ‘ব্যা’। উকিল বললো, ‘খবরদার! বল, নিয়েছিলি কি না।’
চাষা আবার বললো,‘ব্যা’। উকিল বললো, ‘হুজুর! আসামীর বেয়াদবি দেখুন।’ হাকিম রেগে বললেন, ‘ফের যদি অমনি করিস, তোকে আমই ফাটক দেব।’ চাষা অত্যন্ত ভয়ে পেয়ে কাঁদ কাঁদ হয়ে বললো, ‘ব্যা,ব্যা’। হাকিম বললেন, ‘লোকটা কি পাগল নাকি?’
তখন চাষার উকিল উঠে বললো, ‘হুজুর, ও কি আজকের পাগল না, বহুকালের পাগল, জন্মে অবধি পাগল। ওর কি কোনো বুদ্ধি আছে, না কাণ্ডজ্ঞান আছে? ও আবার কর্জ নেবে কি! ও কি কখনো খত লিখতে পারে নাকি? আর পাগলের খত লিখলেই বা কি? দেখুন দেখি, এই হতভাগা মহাজনটার কাণ্ড দেখুন তো! ইচ্ছে করে জেনে শুনে পাগলটাকে ঠকিয়ে নেওয়ার মতলব করেছে। আরে, ওর কি মাথার ঠিক আছে? এরা বলেছে, ‘এইখানে একটা আঙ্গুলের টিপ দে’ পাগল কি জানে, সে অমনি টিপ দিয়েছে। এই তো ব্যাপার!’
দুই উকিলে ঝগড়া বেঁধে গেল। হাকিম খানিক শুনে বললেন, ‘মোকদ্দমা ডিস্মিস।’ মহাজনের তো চক্ষুস্থির। সে আদালতের বাইরে এসে চাষাকে বললো, ‘আচ্ছা, না হয় তোর ৪০০ টাকা ছেড়েই দিলাম ঐ ১০০ টাকাই দে।’
চাষা বললো, ‘ব্যা’ মহাজন যতই বলে, যতই বোঝায়, চাষা তার পাঁঠার বুলি কিছুতেই ছাড়ে না। মহাজন রেগে-মেগে বলে গেল, ‘ আমিও দেখে নেব, আমার টাকা তুই কেমন করে হজম করিস।’
চাষা তার পোঁটলা নিয়ে গ্রামে ফিরতে চলেছে, এমন সময় তার উকিল এসে ধরলো, ‘যাচ্ছ কোথায় বাপু? আমার পাওনাটা আগে চুকিয়ে যাও। একশো টাকায় রফা হয়েছিল, এখন মোকদ্দমা তো জিতিয়ে দিলাম।’ চাষা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ব্যা’।
উকিল বললো, ‘বাপু হে, ওসব চালাকি খাটবে না টাকাটি এখন বের কর।’ চাষা বোকার মতো মুখ করে আবার বললো, ‘ব্যা’। উকিল তাকে নরম গরম অনেক কথাই শোনাল, কিন্তু চাষার মুখে কেবলই ঐ এক জবাব! তখন উকিল বললো, ‘হতভাগা গোমুখ্যু পাড়াগেঁয়ে ভূত, তোর পেটে এত শয়তানি কে জানে! আগে যদি জানতাম তাহলে পোঁটলাসুদ্ধ টাকাগুলো আটকে রাখতাম।’
বুদ্ধিমান উকিলের আর দক্ষিণা পাওয়া হলো না।
লেখা: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
প্রিয় পাঠক, আপনিও অংশ নিতে পারেন আমাদের এ আয়োজনে। আপনার মজার (রম্য) গল্পটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়। লেখা মনোনীত হলেই যে কোনো শুক্রবার প্রকাশিত হবে।
কেএসকে/জেআইএম