বাংলাদেশের পাটশিল্পের নতুন সম্ভাবনা


প্রকাশিত: ০৩:৫৯ এএম, ০৩ মার্চ ২০১৬

বাংলাদেশের মাটি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানের পাট উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত। এ বিষয়টি মাথায় রেখে ১৯৬৪-১৯৬৯ এই পাঁচ বছরে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের একদল ব্যবসায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৭৭টি জুট মিল স্থাপন করেন। দেখা যায়, তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশের  রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে পাট খাত প্রায় ৮০ ভাগ অবদান রেখে আসছিলো। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী পাট সেক্টরের আয়ের একটি বৃহৎ অংশ এদেশে কোনো বিনিয়োগ না করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছিল।

পরবর্তীতে এই বৈষম্যের  বিষয়টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালির চেতনায় একটি বড় অংশ হিসেবে চলে আসে। দেখা গেছে ৮০’র দশকে এসে সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও পলিথিন একটি বড় অংশ দখল করে নেয়। বিশেষ করে পলিথিন হালকা ও সস্তা হওয়ার কারণে পর্যায়ক্রমে পাটজাত পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে থমকে দাঁড়ায়। এর পরেই এ শিল্প আস্তে আস্তে রুগ্ন খাতের দিকে ধাবিত হতে থাকে। উল্লে­খ করা যেতে পারে স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার এই রুগ্ন ও স্থবির শিল্পখাত উন্নয়ন, উত্তরণ, উজ্জীবনের ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।  

যেহেতু এই শিল্পটি স্থাপনের  সময় মূলত ট্রেডিশনাল প্যাকেজিং বা ছালার বস্তা বা এশিয়ান কাপড় তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করার কারণে সীমিতসংখ্যক পণ্যই শুধু উৎপাদন করার সক্ষমতা ছিল।  যেখানে ভারত এই শিল্পে নতুন বাজার ও ক্ষেত্র সম্প্রসারণের  জন্য ৯০ দশকে এসে ট্রেডিশনাল প্রোডাক্টের পাশাপাশি বিভিন্ন নতুন কনজ্যুমার গ্রুপকে ফোকাস করে নতুন নতুন কনজ্যুমার প্রোডাক্ট উৎপাদনের জন্য অন্য ট্রেডিশনাল মেশিনের পরিবর্তে মডার্ন এবং আপগ্রেড টেকনোলজি দিয়ে টেক্সটাইল মেশিন ব্যবহার করে।  তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য একটি জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করে সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারগুলো তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বিশেষ করে এই শিল্পকে যুগোপযোগী  করার ক্ষেত্রে সরকারগুলো যথেষ্ট উদাসীন থাকার কারণে বেসরকারি উদ্যোগও সেভাবে এগিয়ে আসেনি। এইক্ষেত্রে শুধু  কিছুসংখ্যক বেসরকারি উদ্যোক্তার উদ্যোগে ৯০ দশকে এসে বেশকিছু স্পিনিং মিল স্থাপিত হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্থরিব হওয়া এই শিল্পে কিছুটা গতি সঞ্চার হয় এবং এই খাত কিছুটা হলেও এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে।

এইক্ষেত্রে এই স্পিনিং মিল গুলো মূলত কাঁচামাল সরবরাহকারী হিসেবে নিজেদের জায়গা করে নেয়ার চেষ্টা করে। সেখানে ভারতের জুট মিলগুলো বিভিন্ন ধরনের কনজ্যুমারের ফিনিসড প্রোডাক্ট উৎপাদন রফতানির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়েছে। বিশেষ করে গত দুই বছরের মধ্যে প্রাচ্যের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণ ছিল উল্লে­খযোগ্য । আমেরিকার মন্দা অর্থনীতির কারণে কার্পেট ইন্ডাস্ট্রিও আস্তে আস্তে স্থবির হয়ে যায়। এ কারণে স্পিনিং মিলগুলো দু’বছর যাবত লোকসান দিয়ে আসছে। যেখানে সারা বিশ্ব বাজার এখন গ্রীন প্রোডাক্ট, ইকো ফ্রেন্ডলি প্রোডাক্ট, ন্যাচারাল প্রোডাক্টের দিকে ঝুঁকছে। অর্থাৎ হোম টেক্সটাইল, হাউজহোল্ড প্রোডাক্ট, প্যাকেজিং প্রোডাক্ট, লাইফ স্টাইল প্রোডাক্ট, ফ্লোর কাভারিং, গার্ডেনিং ও এগ্রিকালচার প্রোডাক্টসহ বিভিন্ন ধরনের নান্দনিক প্রোডাক্ট উৎপাদনে ভারত, চায়না, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ অন্যান্যরা পাটের সুতা ও ফেব্রিক্স ব্যবহার করে উৎপাদন করে কনজ্যুমার মার্কেটে পৌঁছে দেয়। যেখানে আমরা এখনও ৫০ বছরের পুরনো মেশিন দিয়ে ট্রেডিশনাল প্রোডাক্ট উৎপাদন ও বাজারজাত করার স্বপ্ন দেখছি।

এক্ষেত্রে শুধু কাঁচামাল রফতানি করার স্বপ্ন দেখছে অনেকেই। যা এ খাতকে পিছিয়ে দেয়ার অন্যতম কারণ। অর্থাৎ পাট যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যে সমস্ত সম্ভাবনাময় খাতে পাটকে ব্যবহার করার সুযোগ ছিল, আমরা সে খাতগুলোকে ব্যবহার করার বাস্তবমুখি কোনো পদক্ষেপ নেইনি। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যর্থতাই এই শিল্পকে আজ অবহেলিত শিল্পের দিকে নিয়ে গেছে। বর্তমান সরকারই এ খাতকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ইতোমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও দীর্ঘদিন স্থবির হওয়া এ শিল্পকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট নয়। একটি উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, আমরা যদি এই মুহূর্তে শুধু কাঁচা পাট রফতানি করি তাহলে প্রতিটনে প্রায় ৬শ’ ডলার আয় করা সম্ভব। আর শুধু যদি সুতা রফতানি করা হয় তাহলে ১০০০ থেকে ১২০০ ডলার আয় করা সম্ভব প্রতিটনে। আর যদি ট্রেডিশনাল জুট প্রোডাক্ট রফতানি করা হয় তাহলে প্রতিটনে ১৪০০ থেকে ১৮০০ ডলার আয় হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি ভ্যালু এ্যাডেট জুট প্রোডাক্ট উৎপাদন ও রফতানি করার সুযোগ পাই তাহলে ৩০০০ থেকে ১০০০০ ডলার আয় করা সম্ভব প্রতি টন থেকে।

আমরা এখনও লো ভ্যালু এ্যাডেট প্রোডাক্ট রপ্তানি করে আসছি। অর্থাৎ আমাদের প্রফিট মার্জিন খুবই কম। যে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে যে কোনো সংকট বা সমস্যা সৃষ্টি হলে এ শিল্প থমকে যায়। এক্ষেত্রে পাট খাতের একটি বড় অংশ উন্নত প্রযুক্তির আওতায় ভ্যালু এ্যাডেট প্রোডাক্ট উৎপাদন ও রফতানি করার সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারলে এ খাতের চেহারা পাল্টে যাবে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানের পাট আমাদের দেশেই আছে। যা নেই তা হচ্ছে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকার যদি একটি সহায়ক বিনিয়োগ ও নীতিমালা নিশ্চিত করতে পারে তাহলে এ খাতে এগিয়ে যাওয়ার নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। অনেক দেরিতে হলেও বাংলাদেশ সরকার প্যাকেজিং এ্যাক্ট বাস্তবায়নে যে জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে তা যুগান্তকারী। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এই আইনটি অনেক আগেই বাস্তবায়ন হওয়ার দরকার ছিল। এর আগে এই আইন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বাস্তবায়ন করেছে। অর্থাৎ স্থানীয় বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই শিল্প যে কোনো প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করতে সাহায্য করে। আমরা সরকারের এই পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাই।

পাটখাতের ভবিষ্যত নির্ভর করছে বহুমুখি পাটপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি সম্ভাবনার ওপর। এক্ষেত্রে সরকারকে একটি দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়নের দিকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। যা এ খাতের রপ্তানি আয় বাড়াবে ও লক্ষ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান তৈরি করবে। বাংলাদেশ প্যাকেজিং আইন বাস্তবায়ন করার জন্য আগামী ৬ই মার্চ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু সফল উদ্যোক্তা যারা এই আইন বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেছে তাদেরকে সংবর্ধনা দেবেন। একই সাথে পাটজাত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের জন্য এবং বহুমুখি পাটজাত পণ্য উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য ৩ দিনব্যাপী মেলা হবে। এই মেলা আইনের বাস্তবায়নে পাটজাত পণ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যবহার ও রফতানি সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তবে এই প্যাকেজিং আইন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কতোটুকু সুফল বয়ে আনবে তা সময়ই বলে দেবে।

লেখক : বিজনেস এডিটর, এটিএন বাংলা

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।