অসীম সাহস আর প্রেরণা জোগায় রাবির ‘সাবাস বাংলাদেশ’

মুক্তিযুদ্ধে তরুণদের অবদানকে মাথায় রেখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) মূল ফটকের পশ্চিম পাশে এবং শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ সিনেট ভবনের দক্ষিণ পাশের মাঠ ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে একটি ভাস্কর্য। তার নাম ‘সাবাস বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত যে কয়টি ভাস্কর্য এ যাবত স্থাপন হয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। ৪০ বর্গফুট জায়গার ভেতরে যুদ্ধের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ ভাস্কর্যে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের উদ্যোগে ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্যটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ আহমদ। শিল্পী নিতুন কুন্ডুর শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় লাল বেলে মাটি দিয়ে ১৯৯১ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে এ ভাস্কর্যটি উন্মোচন করেন শহীদ জননী বেগম জাহানারা ইমাম।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া দুই তরুণের ছবি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তাদের অবদানের কথা। একজন পরে আছে প্যান্ট আর অন্যজন লুঙ্গি, যা মুক্তিযুদ্ধে আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণের প্রতীক। একজনের একটি হাতে রাইফেল আর অন্য হাত মাথার ওপরে মুষ্টিবদ্ধ, যা দেশকে স্বাধীন করতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতির বহিঃপ্রকাশ। অন্যজনের দুই হাতে আছে রাইফেল, যা দ্বারা জীবনকে বাজি রেখে ক্ষিপ্রতার সঙ্গে রণাঙ্গনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিশেষ মুহূর্ত ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ভাস্কর্যটির দুপাশে রয়েছে আয়তাকার দুটি দেওয়াল। একটিতে কয়েকজন বাউল একতারা বাজিয়ে গান করছে, যা বাঙালি জাতির গ্রামীণ সংস্কৃতির পরিচয় বহন করছে। অন্যটিতে মায়ের কোলে শিশু ও দুজন তরুণী, একজনের হাতে রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। তার দিকে অবাক তাকিয়ে আছে এক কিশোর। ভাস্কর্যটির নিচে লেখা আছে তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য রচিত দুইটি চরণ, ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে-পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’। ভাস্কর্যটির পাদদেশে আছে একটি মুক্তমঞ্চ। ৪০ বর্গফুট এ ভাস্কর্যের ঠিক পেছনে রয়েছে ৩৬ ফুট উচ্চতার একটি বৃহৎ দেওয়াল। তার মাঝে আছে ৫ ফুট ব্যাসের একটি বৃত্ত। যেটি স্বাধীনতার সূর্যের প্রতীকস্বরূপ।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পায়নি এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক শিক্ষার্থীরাও। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে পাকবাহিনীর হাত থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে নিহত হন অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা। মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর কবলে পড়ে নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হবিবুর রহমান, অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার ও অধ্যাপক মীর আব্দুল কাইয়ুমসহ আরও অনেকেই। তাদের স্মৃতি বহন করছে ভাস্কর্যটি।
সমাজকর্ম বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ইসা হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বুকে সাবাস বাংলাদেশ নামে যে ভাস্কর্যটি আছে তা আমাদের ও পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। এ ভাস্কর্য বাঙালীর জাতিসত্তার পরিচয় বহন করে। সাবাস বাংলাদেশের ভাস্কর্য দেখলেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আরও জানতে ইচ্ছে করে।’
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মলয় কুমার ভৌমিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের লালমাটি দ্বারা তৈরি এই ভাস্কর্যটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করে। ভাস্কর্য বা শিল্পের মাধ্যমে একটি শিশু দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে যা জানতে পারবে তা ১২০ পৃষ্ঠার বই পড়েও জানা যাবে না। সাবাস বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম যা আমাদের সহস্র বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ক্রমাগত যুক্ত করে যাচ্ছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. সুলতান-উল-ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভাস্কর্যটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আপামর মানুষকে স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, বাঙালির ঐতিহ্য মনে করিয়ে দিচ্ছে এ ভাস্কর্য। ভাস্কর্য আমাদের আদর্শের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে।’
মনির হোসেন মাহিন/এসজে/আরএইচ/এএসএম