‘সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি’

বিভ্রান্তিমূলক তথ্যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়!

মো. কামরুজ্জামান মিন্টু মো. কামরুজ্জামান মিন্টু , জেলা প্রতিনিধি, ময়মনসিংহ ময়মনসিংহ
প্রকাশিত: ০৪:০৮ পিএম, ১৯ জুলাই ২০২৫

ময়মনসিংহ শহরের হরিকিশোর রায় রোডে অবস্থিত পরিত্যক্ত যে বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে, সেটি ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের পূর্বপুরুষদের প্রাচীন বাড়ি বলে কয়েকটি গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ফলে বাড়ি ভাঙা নিয়ে কয়েকদিন যাবত আলোচনা সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে।

সেটিই নজরে আসে ভারত সরকারের। বাড়ি ভাঙার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানায় ভারত সরকার। একইসঙ্গে ভবন সংস্কার ও পুনর্নির্মাণে সহযোগিতা করার কথাও জানায় দেশটি। সমালোচনার মুখে ভবন ভাঙার কাজ বন্ধ রাখে শিশু একাডেমি। কিন্তু এরইমধ্যে এক তৃতীয়াংশ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভাঙার কাজ বন্ধ করার দিনই জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নগরীর বিশিষ্টজনদের সঙ্গে জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম এক জরুরি সভা করেন। এসময় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রফেসর বিমল কান্তি দে, স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যকার ও কথা সাহিত্যিক ফরিদ আহাম্মেদ দুলাল, বিশিষ্ট শিক্ষক ও ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ইতিহাস সংরক্ষক স্বপন ধর, বাংলাদেশ শিশু অ্যাকাডেমির অতিরিক্ত সচিব শিউলী রহমান তিন্নীসহ সংশ্লিষ্ট আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

সভায় ব্যক্তিবর্গ কঠোরচিত্তে বলেন, এটি কখনো সত্যজিৎ রায় বা তার পূর্বপুরুষদের বাড়ি না বা তারা কখনো এই বাড়িতে ছিলেন না। তারা যে বাড়িটিতে থাকতেন সেটি পূর্ণলক্ষ্মী নামক পাশের একটি বাড়ি। ইচ্ছাকৃতভাবে একটি মিথ্যা তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য এই তথ্যগুলো ছড়ানো হয়েছে।

বিভ্রান্তিমূলক তথ্যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়!

তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা থেমে নেই। এটি সংরক্ষণ করা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে মত দিচ্ছেন অনেকে।

সমাজ রূপান্তর সাংস্কৃতিক সংঘ, ময়মনসিংহের সভাপতি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি না হলে কি এই প্রাচীন বাড়িটির প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব নেই? অবশ্যই আছে। প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বহনকারী হরিকিশোর রায় রোডের এই বাড়িটিকে তার পূর্বের আদলে ফিরিয়ে আনা হোক।

বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রকাশ করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যকার ও কথা সাহিত্যিক ফরিদ আহাম্মেদ দুলাল। তিনি বলেন, ভেঙে ফেলা শিশু অ্যাকাডেমির ভবনটির পাশে পূর্ণলক্ষ্মী নামক ভবনটি সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি। তবে এই বাড়িটি হাত বদল হওয়ার পর এক তলা থেকে বর্তমানে দুই তলা করা হয়েছে। টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের দানবীর রায় বাহাদুর রনদা প্রসাদ সাহা এটি নির্মাণ করেছিলেন। এটি সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি না। না জেনে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এতে অনেকে ভুল তথ্য পেয়েছে।

বিশিষ্ট শিক্ষক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক স্বপন ধর বলেন, ভাঙা ভবনটি বাহাদুর রনদা প্রসাদ সাহার অস্থায়ী বাড়ি ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক দিক থেকে এই বাড়ি ভাঙা উচিত হয়নি। এই জেলায় ৩২০টি ঐতিহাসিক স্থাপত্যের মধ্যে ৪০টি স্থাপত্যের অস্তিত্ব এখন আর নেই। যেগুলো আছে, সেগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা অতীব জরুরি। কারণ এগুলো নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় সম্পদ।

তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল বলেন, সংস্কৃতির এই শহরে শিশু অ্যাকাডেমির নতুন একটি ভবন নির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। অবিলম্বে এখানে প্রস্তাবিত শিশু অ্যাকাডেমির ভবনটি নির্মাণ করা হোক এবং সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ প্রসারিত হোক।

শুক্রবার (১৮ জুলাই) সকালে জেলা শিশুবিষয়ক কর্মকর্তা মেহেদী জামান জাগো নিউজকে বলেন, বাড়ি ভাঙার কাজ এখনো বন্ধ রাখা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে বাড়িটি পুরোপুরি ভেঙে নতুন ভবন করার কাজ শুরু হবে।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আরএস রেকর্ডে বাড়িটি বাংলাদেশ সরকারের নামে লিপিবদ্ধ। ২০০৮ সালে এটি বাংলাদেশ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ শিশু অ্যাকাডেমির নামে বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তাদের নামে জমির দলিল বন্দোবস্ত করা হয়েছে। এর খতিয়ান রয়েছে।

বিভ্রান্তিমূলক তথ্যে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়!

এ বিষয়ে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বলেন, সিএস, আরএসসহ সকল খতিয়ানে কোনোভাবেই সত্যজিৎ রায় বা তার পরিবারের নাম নেই। শিশু একাডেমি যথাযথ প্রক্রিয়ায় মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে এই ভবনটি ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে একটি গোষ্ঠী মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।

এদিকে এ নিয়ে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, যে বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে সেটির সঙ্গে সত্যজিৎ রায় বা তার পূর্বপুরুষদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি এর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব নেই।

এতে বলা হয়, যেই বাড়িটি ভাঙা হচ্ছে সেটি মূলত স্থানীয় জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী তার কর্মচারীদের জন্য তৈরি করেছিলেন। এটি তার বাংলো ‘শশী লজ’-এর পাশে অবস্থিত। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর বাড়িটি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিকে বরাদ্দ করা হয়।

দীর্ঘদিন জেলা শিশু অ্যাকাডেমির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পর ২০১৪ সালে বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এরপর একাডেমি ময়মনসিংহ শহরের অন্যত্র ভাড়া করা স্থানে কার্যক্রম চালায় এবং পুরোনো বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। পরিত্যক্ত অবস্থায় এটি স্থানীয় অসামাজিক কর্মকাণ্ডের আখড়ায় পরিণত হয়। গত বছরের প্রথমার্ধে শিশু অ্যাকাডেমির জন্য আধাপাকা নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে, শিশু একাডেমি জেলা প্রশাসনকে পুরোনো ভবনটি নিলামের মাধ্যমে অপসারণের অনুমতি দেয়। নিলাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৭ মার্চ জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় এ বিষয়ে সাধারণ জনগণকে অবহিত করা হয়।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।