কুষ্টিয়া

নামের কারণে দুই দশক ধরে ‘পরিত্যক্ত’ জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক

আল মামুন সাগর আল মামুন সাগর , জেলা প্রতিনিধি কুষ্টিয়া
প্রকাশিত: ০৬:৫৭ পিএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
কুষ্টিয়ার শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শিশু পার্কের ফটক। ছবি-জাগো নিউজ

কুষ্টিয়া শহরের একেবারেই প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক। তবে পার্কে শিশুদের পদচারণা নেই। শুধু ‌‘জিয়া’ নামের কারণে প্রায় দুই দশক ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে পার্কটি।

একসময় মানুষের ভিড় লেগে থাকা পার্কে এখন দিনেও মেলে না ৫০ জন দর্শনার্থী। একটু বিনোদনের আশায় শিশু-সন্তানদের নিয়ে শহরের বাসিন্দারা দূর গ্রামে ছুটলেও ঘরের কোণে থাকা পার্কটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে পার্কটি প্রেমিক যুগল আর বখাটে ছেলেদের নিরিবিলি আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে।

৮০-৯০ এর দশকের কোনো একসময়ে প্রতিষ্ঠিত পার্কটিতে রয়েছে পুকুর, সুইমিং পুল, হাঁটার রাস্তা ও শিশুদের বিনোদনের জন্য হরিণসহ কয়েক প্রজাতির পশুপাখি। তবে সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় পার্কটি দিন দিন তার জৌলুস হারিয়েছে। বিশাল আয়তনের পুকুরটিতে একসময় মাছ চাষ হলেও বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে।

পার্কে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে একটি সুইমিং পুল। সেখানে শিশু-কিশোরদের সাঁতার শেখানোর উদ্যোগে সাড়া মিললেও পর্যাপ্ত ট্রেনার ও সুযোগ-সুবিধা না থাকায় আগ্রহ হারাচ্ছেন অভিভাবকরা।

সরেজমিনে পার্কে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান গেটে মোজাইকের ওপর ছবিসহ কালো কালি দিয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কথাটি বড় অক্ষরে আর লাল কালি দিয়ে ছোট অক্ষরে শিশু পার্ক লেখা। জায়গায় জায়গায় মোজাইক উঠে গিয়ে ইট দেখা যাচ্ছে। এক নজর তাকালেই বোঝা যাবে দীর্ঘদিন এখানে সংস্কার বা যত্নের কোন ছোয়া লাগেনি।

নামের কারণে দুই দশক ধরে ‘পরিত্যক্ত’ জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক

পার্কে ঢুকতেই ভেতরে কাউন্টার। সেখানে দেখা গেলো, ইনচার্জ তরিকুল ইসলাম বসে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সারাদিনে ২০-৩০ জন দর্শনার্থী আসে। অথচ একটা সময় অনেক মানুষ আসতো। এখন আর তেমন আগ্রহ নেই মানুষের।’

পার্কের মাঝামাঝি খাঁচায় কবুতর ও শেষ প্রান্তে একটি বড় খাঁচায় ১৫টি হরিণ রয়েছে। হরিণগুলোর জন্য খাঁচার ভেতর কোনো খাবার দেখা না গেলেও দায়িত্বশীলরা জানান, প্রতিদিনই ঘাস ও অন্যান্য খাবার দেওয়া হয় হরিণগুলোকে।

নামের কারণে দুই দশক ধরে ‘পরিত্যক্ত’ জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক

পার্কের ডানপাশে পুকুরের চারদিকে বন-জঙ্গল। সাপ-পোকার ভয়ে পুকুরপাড়ে হাঁটা দায়। ঘুরতে আসা দর্শনার্থী সবাই উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণী।

শহরের সচেতন নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নোংরা রাজনীতির বলি হয়ে রয়েছে এক সময়ের কোলাহল পূর্ণ এই শিশু পার্কটি। শুধু শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম থাকায় পার্কটি গত প্রায় দুই দশক ধরে অযত্ন-অবহেলায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

নামের কারণে দুই দশক ধরে ‘পরিত্যক্ত’ জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিএনপির শেষ সময় এবং আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা চার মেয়াদে প্রথম শ্রেণির কুষ্টিয়া পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আলী। তিনি এক মেয়াদ বাদ দিয়ে কুষ্টিয়া পৌরসভার পাঁচবারের নির্বাচিত মেয়র।

সচেতন নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের দাবি, নোংরা রাজনীতির অংশ হিসেবে শুধু শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামে হওয়ার কারণে পাঁচ মেয়াদে দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর কুষ্টিয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান ও মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালে আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার আলী পার্কটির উন্নয়নতো দূরের কথা, দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার না করে পার্কটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দিয়েছেন।

১৯৯৯-২০০০ সালের দিকে একবার আনোয়ার আলীকে ভোটে পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রয়াত খন্দকার ইসরাইল হোসেন আফু। তিনিও পার্কটি সংস্কার করার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী কুষ্টিয়ার সন্তান কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সহায়তায় শহরের ঈদগাহ পাড়া এলাকায় কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর নামে নতুন একটি শিশু পার্ক নির্মাণ করেন।

নামের কারণে দুই দশক ধরে ‘পরিত্যক্ত’ জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক

এ বিষয়ে পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ওয়াহিদুর রহমান বলেন, সম্প্রতি গুলশানের একটি পার্ক আমরা পরিদর্শন করে দেখেছি। সেটা সবসময় জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। সেখানে শহরের বাসিন্দারা বিশ্রাম নিতে পারেন। আমরা সেই আদলেই জিয়াউর রহমান শিশু পার্কটি সাজানোর পরিকল্পনা করছি। খুব শিগগির এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

শিশুদের বিনোদন কেন্দ্র নিয়ে কোনো রাজনীতি হওয়া উচিত নয় বলে মনে করেন পরিবেশকর্মী খলিলুর রহমান মজু। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, শিশুপার্ক মানে শিশুদের নির্মল বিনোদনের জায়গা। সেখানে রাজনীতি কাম্য না। আমাদের দাবি থাকবে, দ্রুত পার্কটির সংস্কার কাজ করে শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করা হোক।

নামের কারণে দুই দশক ধরে ‘পরিত্যক্ত’ জিয়াউর রহমান শিশু পার্ক

পার্কটি শুধুমাত্র নামের কারণে প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অবহেলিত বলে দাবি করেন কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সদস্য সচিব প্রকৌশলী জাকির হোসেন সরকার।

তিনি বলেন, ‘এ কথা সত্য শুধু নামের কারণেই পার্কটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে ছিল। ৫ আগস্টের পর দলীয়ভাবে সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য সেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কার্যক্রম পরিচালনা করি। সেখানে মানুষ হাঁটার পরিবেশও ছিল না।’

পার্কটি নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, এটা খুবই ভালো উদ্যোগ হতে পারে। সরকারিভাবে দ্রুত পার্কটি সংস্কার করে দর্শনার্থীদের জন্য ব্যবহার উপযোগী হিসেবে ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানাই।

আল-মামুন সাগর/এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।