এমপিওভুক্তিতে দুর্নীতি

তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও বহাল তবিয়তে সেই ৫ কর্মকর্তা

সাখাওয়াত হোসেন
সাখাওয়াত হোসেন সাখাওয়াত হোসেন , জেলা প্রতিনিধি রাজশাহী
প্রকাশিত: ০৭:০০ পিএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫
রাজশাহী অঞ্চলে এমপিওভুক্তিতে দুর্নীতিতে জড়িত পাঁচ কর্মকর্তা

রাজশাহী অঞ্চলে এমপিওভুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়ম, তথ্য জালিয়াতি, ঘুস লেনদেন এবং বিধিবহির্ভূত অনুমোদনের অভিযোগ তদন্তে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদের বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গত ১৪ অক্টোবর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।

তদন্তে পরিচালক (কলেজ) বিশ্বজিৎ ব্যানার্জি, সহকারী পরিচালক মো. আলমাছ উদ্দিন এবং সেসিপ প্রকল্পের তিন কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র প্রামানিক, আসমত আলী ও রাশেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ দালিলিকভাবে প্রমাণিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, প্রগতিশীল নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি আইনজীবী এনামুল হক, তোরাব আলী পারভেজ, কাওসার আলী এবং জাতীয়তাবাদী কলেজ শিক্ষক সমিতির পক্ষে এরশাদ হোসেন ও রুহুল আমিনের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়। গত ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষের দপ্তরে অনুষ্ঠিত তদন্তে অভিযোগকারী, অভিযুক্ত কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক পরিচালকের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ ও নথিপত্র বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।

তদন্ত দলের প্রধান ছিলেন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক যহুর আলী। কমিটিতে আরও ছিলেন মাউশির উপপরিচালক শহিদুল ইসলাম এবং সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ সফিউল বশর।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যানবেইস ডাটাবেসে কোনো তথ্য না থাকা সত্ত্বেও ছয়জন প্রভাষক এবং এক অফিস সহকারীকে এমপিওভুক্ত করা হয়, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা এবং ব্যানবেইস সংক্রান্ত নির্দেশনার সরাসরি লঙ্ঘন। এছাড়া নাচোল মহিলা কলেজের আট শিক্ষক ২০১৭ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও কাগজপত্রে তারিখ জালিয়াতি করে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগের নিয়োগ দেখিয়ে তৃতীয় শিক্ষক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির আগেই নিয়োগ দেখানো হয়েছে যা স্পষ্ট জালিয়াতির প্রমাণ বহন করে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির অনুমতি ছাড়া সমন্বয় এমপিওভুক্তির কোনো সুযোগ নেই। অথচ বাশেরবাদা ও কাকনহাট ডিগ্রি কলেজের তিন প্রভাষককে কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই এমপিওভুক্ত করা হয়। একইভাবে ২০১৯ সালে মোজাহার হোসেন ডিগ্রি কলেজের পাঁচ শিক্ষককে এনটিআরসিএর সুপারিশ ছাড়াই কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে, যা ২০১৬ সালের পর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, দুটি অনুমোদনহীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নিয়ে দুই শিক্ষক এমপিও পেয়েছেন। ‘দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’ ও ‘অতীশ দীপংকর বিশ্ববিদ্যালয়’র ডিগ্রি ইউজিসি অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে তাদের এমপিওভুক্ত করেছেন। ব্যানবেইসে তাদের কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি।

দুর্নীতির অভিযোগ কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। নাটোর মহারাজা জে এন কলেজের একজন শিক্ষককে এমপিও করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে চার লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগও তদন্তে সত্য প্রমাণিত হয়।

কলেজের অধ্যক্ষ লিখিতভাবে জানান, সহকারী পরিচালক আলমাস উদ্দিনের উপস্থিতিতে সেসিপ কর্মকর্তা মানিক চন্দ্র প্রামানিক তাদের কলেজে এসে এমপিও ফাইলের কাজ করে দেওয়ার কথা বলে অর্থ দাবি করেন। অর্থ লেনদেন নিয়ে পরবর্তীতে বিরোধের সৃষ্টি হলে তা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ব্যানবেইস ডাটাবেস জালিয়াতি, তারিখ টেম্পারিং, ঘুস লেনদেন, বিধিবহির্ভূত তৃতীয় শিক্ষক তালিকা প্রণয়ন, অনুমতি ছাড়া সমন্বয় এমপিও, অনুমোদনবিহীন ডিগ্রিতে এমপিও প্রদান এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্যসহ সবগুলো অভিযোগই দালিলিক প্রমাণসহ নিশ্চিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

এ বিষয়ে তদন্ত দলের প্রধান রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যক্ষ মো. যহুর আলী বলেন, ‌‌‘আপনারা যে তদন্ত প্রতিবেদনটি দেখালেন সেটি আমাদরেই তৈরি করা। এখানে যে সই আছে সেইটিও আমাদেরই করা। এখানে সব অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে। আমার তদন্ত শেষ করে। প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। এখন করণীয় কী হবে সেটি তারা ঠিক করবে।’

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনের জমা দেওয়ার এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো বহাল তবিয়তে কাজ করে যাচ্ছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। তাদরে বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি মন্ত্রণালয়।

মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-২) ফজলুল হক মনি বলেন, ‘আমাদের আসলে কিছু করার নেই। আমরা সেতু বন্ধনের মতো। মন্ত্রণালয় আমাদের নির্দেশ নিয়েছে, আমরা তদন্ত কমিটি করে দিয়েছি। এখন প্রতিবেদন পেয়েছি। নভেম্বর মাসের প্রথম দিকেই সেই প্রতিবেদন আমরা পাঠিয়ে দিয়েছে। এ বিষয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক এখন মন্ত্রণালয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা ও আইন শাখার উপসচিব আশরাফুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কোনো তথ্য জানেন না।

বিষয়টি নিয়ে জানতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক বি এম আব্দুল হান্নানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। দুদিন তার দপ্তরে গেলে তিনি সচিবালয়ে বলে জানান তার একান্ত সচিব (পিএস)। পরবর্তী সময়ে মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।