এক সময়কার খরস্রোতা চৌমুহনী খাল এখন নালা


প্রকাশিত: ০৩:৫২ পিএম, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ঐতিহ্যবাহী নোয়াখালীর প্রধাণ বাণিজ্য কেন্দ্র চৌমুহনী। বাণিজ্য কেন্দ্রের ওপর দিয়ে প্রবাহিত এক সময়কার খরস্রোতা ‘চৌমুহনী খালটি’ এখন নালায় পরিণত হয়েছে। দিন দিন অবৈধ দখলদারদের খাল দখলের প্রতিযোগিতা ও আর ময়লা আর্বজনা ফেলার ফলে দখলে আর দূষণে খালটি বর্তমানে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম।

প্রশাসনের চোখের সামনে এ অবস্থা চললেও খালটি দখলমুক্ত করে সংস্কারের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ কেউ গ্রহণ করা হচ্ছে না।  

স্থানীয়রা জাগো নিউজকে জানান, একটা সময়ে নদীর বুক চিরে জেগে উঠেছিল নোয়াখালী। আর নোয়াখালীর বুক চিরে নোয়াখালী খাল, ওয়াপদা খাল, ছাগলামারা ও মহেন্দ্র খালসহ ছিল ছোট-বড় ২৮৮টি খাল। এই সব খালগুলোকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় হাট বাজার। চৌমুহনী এর মধ্য অন্যতম।

ছাতারপাইয়া, আটিয়াবাড়ি, চন্দ্রগঞ্জ ও ফেনী খালের চার মোহনায় শত বছরের বেশি ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্য কেন্দ্র চৌমুহনীর যাত্রা শুরু হয়।

জলপথে বাণিজ্যের জন্য সরাদেশে বিখ্যাত ছিল চৌমুহনী। দেশের বিভিন্ন স্থানই নয় সুদূর কলকাতা থেকে বড় বড় নৌকা ও সাম্পানে করে মালামাল আসতো পূথিঘর লাইব্রেরী খ্যাত চৌমুহনীতে। পর্যায়ক্রমে বৃহদাকারের ৬টি নৌকা ঘাট স্থাপিত হয় এখানে। যা শুধু এখন স্মৃতি। একসময় এই খালগুলো ছোটখাটো নদীর আকৃতি থাকলেও গত দুই দশক ধরে খালের দুই পাশ থেকে দখলদারদের কবলে পড়ে পর্যায়ক্রমে এই খালগুলো নালায় পরিণত হয়েছে।

খাল ভরাট হয়ে যাওয়া এই খালের মাঝ দিয়ে এখন চলাচল করা যায়। খাল দখল প্রক্রিয়ায় বৃহৎ দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে যেমন সমঝোতা লক্ষ্য করা গেছে, তেমনি অনেক জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী নেতারা এ খাল দখলের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে।

Noakhali

বিশিষ্ট সমাজসেবক আবদুল লতিফ মাস্টার জানান, খালতো এখন শুধুই স্মৃতি। যে খাল দিয়ে বড় বড় পাল তোলা নৌকা আসতো আর বর্ষা মৌসুমে প্রচুর মাছ ধরা যেতো সেটি এখন দখল আর দূষণে মৃত। কোথায় নদী আর কোথায় খাল কিছুই নেই। এক শ্রেণির ভূমি দুস্যুরা এটি দিন দিন খেয়ে ফেলছে।

বাজারের ব্যবসায়ী নিউ ফার্মেসির মালিক তপন মজুমদার জানান, বাজারের দক্ষিণ দিনে খালের দৈর্ঘ্য ১১০ ফুট আর বড়পুল থেকে পূর্ব দিকের খালটির দৈর্ঘ্য ৬০ ফুট থাকার কথা থাকলে ও এটি এখন কোথাও কোথায় মাত্র ২০ থেকে ২৫ ফুটে দাঁড়িয়েছে। খালটি যে কোনো মূল্যে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।

চৌমুহনী ব্যাংক রোডের মনির অ্যান্ড সন্সের মালিক জাফর উল্যা মাসুদ জানান, খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ ব্যবসায়ীদের। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে বাজারের পানি নামতে না পারায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এবং অনেক দোকানে পানি প্রবেশ করে লাখ লাখ টাকার ক্ষয়-ক্ষতি হয়।

এদিকে, খালটি যে শুধু দখল হচ্ছে তা নয়। চৌমুহনী বাজারের হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা বাড়ির অধিকাংশ বর্জ্য ফেলা হয় এ খালে। ফলে ময়লা আবর্জনা দুগন্ধে পরিবেশ মারাত্মক হুমকি মুখে। প্রথমে ময়লা আবর্জনা ফেলা হয় ।পরে তার ওপর দোকানের পেছনের অংশ বৃদ্ধি হয় দখল প্রক্রিয়া চলে।

সাধারণ ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ভোটের সময় আসলে মেয়র ও কাউন্সিলরগণ এই খাল দখলমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু পরে আর কিছুই হয় না। এমনকি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা সে অঙ্গীকার করেন। কিন্তু দেখা গেছে খাল দখলের সাথে অনেক জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী নেতা  জড়িত। বিভিন্ন সময়ে খাল দখলমুক্ত করার কথা উঠলে তা ঠেকানোর জন্য কোটি টাকার বাণিজ্য চলে। ফলে সেটি আর আলোর মুখ দেখে না।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালের ওপর থেকে কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও পরবর্তী সময়ে আবার তারা বহাল হয়ে যায়। তাদের উচ্ছেদ করারা কেউ আর পদক্ষেপ নেয়নি।

তবে খাল দখলে যে অভিযোগ কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সেই চৌমুহনী সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ ভোটের সময় তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি খাল দখলমুক্ত করতে এবার নড়েচড়ে উঠেছেন।

Noakhali

এ বিষয়ে চৌমুহনী সাধারণ ব্যবসায়ী সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি হুমায়ুন কবির জাগো নিউজকে জানান, আমরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়ে ভোট করেছি এবং খাল দখলমুক্ত করা হবে। সরকার, সাধারণ জনগণ ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিচার করে যে মূল্যে খালের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে।

বেগমগঞ্জ ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চৌমুহনী খালের ওপর অবৈধ স্থাপনা ২৫০টি হলে ও এর হিসাব চূড়ান্ত করা হলে আরও বাড়তে পারে। এতে চৌমুহনী মদনমোহন উচ্চ বিদ্যালয় যে বহুতল মার্কেটি করেছে তাও অনেকটা খালের জায়গা দখল করে করা হয়েছে।  

চৌমুহনী পৌরসভার মেয়র আক্তার হোসেন ফয়সাল জাগো নিউজকে জানান, সম্প্রতি সরকার নোয়াখালীর বিভিন্ন খাল ও বামনী নদীতে বাঁধ নির্মাণের জন্য ৩২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন।

চৌমুহনী খালটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন হলে যেহেতু চৌমুহনী পৌরসভার মধ্যে এর অবস্থান তাই এর দায় পৌরসভা কৃর্তপক্ষের ওপর পড়ে। আর তাই সচেতন ব্যবসায়ী ও পৌর নাগরিকের দাবির মুখে পৌর প্রশাসন ও খাল দখলমুক্ত করে খালের আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছেন। খাল দখলমুক্ত করতে প্রশাসন ও বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করা হয়েছে।  

কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো বড় শক্তির কাছে তিনি মাথা নত করবেন না। এটি তার অঙ্গীকার।  জন্য তিনি সকলের সহযোগীতা চেয়েছেন।

এআরএ/জেআইএম

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।