কুমিল্লায় পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও রয়েছে অন্তহীন সমস্যা


প্রকাশিত: ০৭:০৫ এএম, ২১ মে ২০১৫

কবি নজরুল, রবি ঠাকুর, মহাত্মাগান্ধী ও সঙ্গীত সাধক বাবু শচীন দেব বর্মনের স্মৃতি বিজড়িত দেশের পূবাঞ্চলীয় সীমান্তবর্তী প্রাচীন ও ঐতিহ্যমণ্ডিত জেলা কুমিল্লা। ঐতিহ্যে-আভিজাত্যে ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত থাকার কারণে গোমতী বিধৌত কুমিল্লার সুনিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশ, ঐতিহাসিক নির্দশনসহ বিভিন্ন কারণে সমগ্র দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের নিকট কুমিল্লা ক্রমেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কিন্তু পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখানে অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এখনো কাঙ্খিত পর্যায়ে গড়ে উঠেনি।

জানা যায়, ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে কুমিল্লা আসার জন্য রেলপথ অথবা সড়কপথে যাতায়াতের সুব্যবস্থা রয়েছে। কুমিল্লায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে লালমাই পাহাড়। এ পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়ায় উঠে অনায়াসেই কুমিল্লা শহরকে দেখা যায়। এই পাহাড় এলাকা এবং এর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক প্রাচীন নিদর্শন।



 লালমাই পাহাড়ের পাশে রয়েছে শালবন বিহার। পূর্বে এ প্রত্নস্থানটি শালবন রাজারবাড়ি নামে পরিচিত ছিল। কুমিল্লা মহানগর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে ময়নামতি (কোটবাড়ি) অবস্থিত। এখানে অষ্টম শতকের পুরাকীর্তি রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন স্পটের মধ্যে শালবন বিহার ও বৌদ্ধ বিহার অন্যতম।

শালবন বিহার দেখার পর ৩ মাইল উত্তরে রয়েছে কুটিলামুড়া। এখানে তিনটি বৌদ্ধ স্তুপ আছে। কুটিলামুড়া দেখার পর এটি থেকে প্রায় দেড় মাইল উত্তর-পশ্চিমে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত চারপত্র মুড়া। প্রায় ৩৫ ফুট উঁচু একটি ছোট ও সমতল পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান। যা পূর্ব-পশ্চিমে ১০৫ ফুট লম্বা ও উত্তরে-দক্ষিণে ৫৫ ফুট চওড়া ছিল। পাহাড়পুর বিহারের পরই এর স্থান।

এছাড়াও রয়েছে রূপবান মুড়া ও কুটিলা মুড়া। এখানে রয়েছে ময়নামতি যাদুঘর। জাদুঘরের পাশে বন বিভাগ নতুন ২টি পিকনিক স্পট করেছে। এসব স্থানে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের আগমনের কারণে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকদের জীবিকা নির্বাহ করার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের আয় এবং বিনোয়োগ বাড়ছে। এছাড়াও জাদুঘর, বিহার, চিড়িয়াখানা এবং রাজেশপুর বিটে ইজারা খাতে সরকারি রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।



১৯৫৯ সালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) প্রতিষ্ঠিত হয়। বার্ডের ভেতরের নয়নাভিরাম দৃশ্য ছাড়াও রয়েছে নীলাচল পাহাড়। তাছাড়া দু’পাহাড়ের মাঝখানে রয়েছে অনিন্দ্য সুন্দর বনকুটির। যা পর্যটকদের নিকট খুবই আকর্ষণীয়। কুমিল্লা জেলার লাকসাম, বারুড়া ও সদর থানার ত্রিমুখি মিলনস্থলে লালমাই পাহাড়ের শীর্ষ দেশে চন্ডি মন্দিরদ্বয় অবস্থিত। এলাকাটি চন্ডিমুড়া হিসেবে পরিচিত। ত্রিপুরাধিপতির বংশধর দ্বিতীয়া দেবী প্রতিষ্ঠিত চন্ডি মন্দিরদ্বয় ১৩শ’বছরের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী।

প্রাচীন তাম্রলিপি অনুযায়ী জানা যায়, সমতট রাজ্যটি স্থাপন করার সময় মন্দির দু’টি নির্মিত হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা সদর দক্ষিণের লালবাগ নেমে সামনে ১ কিলোমিটার দূরেই রাজেশপুর ফরেস্ট। এখানে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী নোম্যান্স ল্যান্ড রয়েছে। সেখানকার সবুজ অরণ্যে পাখির কিচির-মিচির শব্দ শুনতে প্রতিদিন পর্যটকরা ভীড় জমায়।

বর্তমানে বন বিভাগের অনেক উন্নয়ন করায় পর্যটকরা আকৃষ্ট হচ্ছে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ময়নামতি-কোটবাড়ি এলাকায় বনবিভাগ নানা স্থাপনা ও উন্নয়ন করেছে। বেসরকারি উদ্যোগে নগরীর রাজাপাড়া এলাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক বিভিন্ন নান্দনিক স্থাপর্ত্য শিল্পের আদলে প্রতিষ্ঠা করেছে নুরজাহান ইকো পার্ক। সেখানে মাত্র ১০ টাকার টিকেটে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ভীড় জমায়।

বাদশাহ্ আওরঙ্গজেবের ভাই শাহজাদা সুজার নাম অনুসারে সুজা মসজিদ নির্মিত হয়েছে। কুমিল্লা মহানগরীর মোগলটুলিতে এর অবস্থান। ১৬৫৭ সালে প্রাচীন স্থাপত্যের আদলে এ মসজিদ নির্মাণ করা হয়।

মহানগরীর বাদুরতলায় ধর্মসাগর অবস্থিত। প্রায় সাড়ে ৫শ’ বছর আগে রাজা ধর্মমাণিক্য এটি খনন করেন। এর আয়তন ২৩.১৮ একর। চারদিকে বৃক্ষশোভিত একটি মনোরম স্থান। তীর সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে।

নগরীর এলজিইডি রোডে ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিবহুল বাড়ি, নবাব বাড়িতে শচীন দেব বর্মন, কবি নজরুল এবং অভয়াশ্রমে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত স্থান পর্যটকদের আকৃষ্ট করছে। কবি নজরুল-নার্গিসের বাসর শয্যা থেকে শুরু করে অনেক স্মৃতি বিজড়িত স্থান দেখতে পর্যকটরা আগমন করছে কবি তীর্থ জেলার মুরাদনগরের দৌলতপুরে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ওয়ার সিমেট্রি কুমিল্লা-সিলেট সড়কের পাশে ময়নামতি সেনানিবাসের উত্তরে অবস্থিত। সকাল ৭টা-১২টা এবং ১টা-৫টা পর্যন্ত সেখানে পর্যটকরা ভীড় জমায়। এছাড়া এটি একটি অন্যতম পিকনিক স্পট। এখানে ব্রিটিশ, কানাডিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান, নিউজিল্যান্ডিয়ান, আফ্রিকান, জাপানি, আমেরিকান এবং ভারতীয় মিলে ৭৩৭ জন সৈন্যের সমাধি রয়েছে।

কুমিল্লা-সিলেট রোডের কুমিল্লা বুড়িচংয়ের সাহেববাজারে রাণীর বাংলো অবস্থিত। এখানকার দেয়ালটি উত্তর-দক্ষিণে ৫১০ ফুট লম্বা ও ৪০০ ফুট চওড়া। এখানে স্বর্ণ ও পিতল নির্মিত দ্রব্যাদি পাওয়া গেছে।

হযরত শাহজালালের সফরসঙ্গী শাহ জামালসহ মোট ৩০ জন আউলিয়ার মাজার রয়েছে দেবিদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামে। এখানে অবস্থিত কবরগুলো প্রায় ৭শ’ বছরের পুরনো। এখানে ৩০টি কবর আছে। দেবিদ্বারের গুনাইঘর গ্রামে রয়েছে নান্দনিক কারুকার্য সম্বলিত গুনাইঘর বায়তুল আজগর সাত গুম্বজ জামে মসজিদ। জেলার লাকসামের পশ্চিমগাঁওয়ে ডাকাতিয়া নদীর তীরে রয়েছে নারী জাগরণের পথিকৃৎ নবাব ফয়জুন্নেছার বাড়ি।



কুমিল্লাবাসীর সুখ-দুঃখের সাথী গোমতী নদী। মহানগরীর পাশ দিয়ে প্রবাহমান এ গোমতী নদীর তীরে বিকেলে পর্যটকদের ঢল নামে। এছাড়া কুমিল্লা সদর উপজেলা মিলনায়তনের পাশে কেটিটিসির পর্যটন কেন্দ্র।

এছাড়াও নগরীতে মহাত্মা গান্ধী ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লার স্থান গুলিতেও পর্যটকরা ভীড় জমায়। নগরীর বাগিচাগাঁয়ে রয়েছে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের অন্যতম নেতা অতীন রায়ের বাড়ি।

কুমিল্লা নগরীতে পর্যটকদের জন্য রয়েছে সিটি পার্ক, চিড়িয়াখানা ও শতবর্ষী কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ। নগরীতে ইপিজেড থাকার কারণে ব্যবসায়িক কাজে আসছেন অনেক বিদেশি পর্যটক। পর্যটকদের সুবিধার্থে মহাসড়কের পাশে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে অনেক হোটেল-মটেল। ময়নামতি-লালমাই পাহাড়কে ঘিরে সেখানকার সৌন্দর্যমন্ডিত স্থানে বেসরকারি উদ্যোগে বিনোদন ও পিকনিক স্পট প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

এদিকে কুমিল্লার বিখ্যাত স্থানসমূহ দেখার পর পর্যটকদের জন্য থাকার সুব্যবস্থা হিসেবে কুমিল্লা বার্ড, জেলা পরিষদ রেস্ট হাউজ ও ডাক বাংলো, নজরুল ইনস্টিটিউট, হোটেল রেড-রফ-ইন, হোটেল নূরজাহান, ময়নামতি, কিউ প্যালেস, রাণীর কুটির, আশিক ও সোনালী নামের আবাসিক হোটেল রয়েছে। সেই সাথে খাবারেরও ভালো আয়োজন রয়েছে এ কুমিল্লায় । হোটেল ডায়না, মিয়ামী, হাইওয়ে ইন, ডলি রিসোর্ট, বাঙলা রেস্তোরাঁ, কাশ্মীর বিরিয়ানী হাউজ, গ্রিন কেস্টলে, কস্তুরী, কিং ফিশার, কফি হাউজ, কাকলী, পানকৌড়িসহ রয়েছে অসংখ্য ভাল মানের খাবারের হোটেল।

সেই সাথে কুমিল্লা থেকে ফিরে যাওয়ার সময় কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাটি রসমালাই এবং খাদি কাপড়ের বিশাল সমাহার তো নগরীতেই রয়েছেই। কিন্তু কুমিল্লাঞ্চলে পর্যটনের এতো সম্ভাবনাময় স্পট থাকার পরও রয়েছে অন্তহীন সদস্যা। কোটবাড়ি-শালবন এলাকায় এখনো পর্যটকদের জন্য নেই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সেখানে বেড়েছে বখাটেদের উৎপাত। প্রায়ই ঘটে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা। নেই কোনো ভাল মানের খাবার কিংবা আবাসিক হোটেল।

শালবন বৌদ্ধ বিহার এলাকায় পর্যটকদের জন্য অবকাঠোমোগত কোন সুযোগ-সুবিধাও নেই। লালমাই পাহাড় রক্ষায় সরকারের কোন সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা না থাকায় ভূমিদস্যুদের কালো থাবায় ইতিমধ্যেই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ওই পাহাড়। অথচ সেখানেই পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিলে বিনোয়োগ, কর্মসংস্থান ও সরকারি রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেত।

তবে আশার কথা হচ্ছে, কুমিল্লা সামাজিক বনবিভাগ কোটবাড়ি ও রাজেশপুর ফরেস্ট বিট এলাকায় দেশ বিদেশের পর্যটকদের জন্য বিনোদন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে এরই মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কোটবাড়ি এলাকায় পিকনিক স্পট নির্মাণ, ৫টি রেস্ট কর্ণার, ৩টি শৌচাগারসহ অবকাঠোমোগত প্রকল্পসহ বিভিন্ন পশু-পাখির নান্দনিক কারুকার্য সম্বলিত ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে।

অপরদিকে সদর দক্ষিণ উপজেলার রাজেশপুরে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত রাজেশপুর ফরেস্ট বিটে রয়েছে ব্যাপক প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। এই ইকোপার্কে ৮৪ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৩৫ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে ৬ প্রজাতির উভচর, ৪০ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ১২৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। ইকোপার্কে তৈরি করা হয়েছে নয়নাভিরাম সুসজ্জিত প্রবেশ পথ, পিকনিক শেড এবং বনশ্রী বিশ্রামাগারসহ পশু-পাখির নান্দনিক কারুকার্য সম্বলিত ভাস্কর্য, রয়েছে পর্যটকদের জন্য নানা সুযোগ সুবিধা।

এ ব্যাপারে কুমিল্লা সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান জানান, রাজেশপুর এবং কোটবাড়ি এলাকায় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের বিনোদনের জন্য আরো সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। কোটবাড়ি ও রাজেশপুর ফরেস্ট বিটে পর্যটকদের আকৃষ্ট ও বনভূমি রক্ষায় বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে বলেও তিনি জানান।

এসএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।