৪ মাসেও কাটেনি নির্বাচনের রেশ : বাড়িছাড়া ২০০ পরিবার
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পেড়লী গ্রামে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চারমাস ধরে বাড়িছাড়া ২০০ পরিবার। শুধু বাড়িছাড়া নয়, প্রতিপক্ষের লোকজন এসব পরিবারের বসত ঘর থেকে শুরু করে রান্নাঘর, গোয়ালঘর ভেঙেচুরে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে পুলিশ বলছে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।
খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে এসব পরিবারের বিছানাসহ আসবাবপত্র। ভয় ও আতঙ্কে স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় যেতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। কোনো কোনো পরিবারের শিশু ও নারীরা দিনের বেলা বাড়িতে আসলেও রাতের বেলা থাকতে পারছেন না।
পেড়লী গ্রামের ওই ২০০ পরিবার বঞ্চিত হয়েছেন ঈদ উৎসব থেকেও। এছাড়া চারমাস ধরে বাড়িঘরে লুটপাট চলছে বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাতেও ওই গ্রামের মিঠু শিকদারের বাড়িতে লুটপাট হয়েছে। দুর্বৃত্তরা তালা ও গ্রিল ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে প্রায় আড়াই লাখ টাকার মালামাল নিয়ে গেছে বলে জানান মিঠু শিকদারের আত্মীয়-স্বজনরা। ভয় ও আতঙ্কে মিঠু শিকদারের পরিবারের সদস্যরা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন বলে জানা গেছে। গত চার মাসে এরকম অন্তত ৫০টি বাড়িতে লুটপাট করা হয়েছে।

জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন (ইউপি) পরবর্তী সহিংসতার জের ধরে ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ২৫ মে আওয়ামী লীগের দুইপক্ষের সংঘর্ষে কালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি পেড়লী গ্রামের মোফাজ্জেল হোসেন (৫০) নিহত হন। এর আগে ২৩মে পেড়লী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিহত মোফাজ্জেল হোসেন চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী বিদ্রোহী প্রার্থী জারজিদ মোল্যার সমর্থক ছিলেন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী জাহাঙ্গীর হোসেন ইকবাল পরাজিত হন। মোফাজ্জেল হত্যাকাণ্ডের পর পেড়লী গ্রামে প্রতিপক্ষের অন্তত ৫০টি বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাকা দালান ঘর ও টিনের ঘরগুলো ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও বিধ্বস্ত ঘর এলোমেলো ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এ ঘটনায় প্রায় ২ কোটি টাকার সম্পদ খোয়া গেছে বলে জানিয়েছেন পেড়লী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম বাবুসহ ক্ষতিগ্রস্তরা।
পেড়লী গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর ও আসবাবপত্রের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। এতদিনেও স্বাভাবিক হতে পারেননি ক্ষতিগ্রস্তরা। ফিরতে পারছেন না বাড়িতেও। বিশেষ করে পুরুষেরা বাড়িছাড়া।
গ্রামের কিবরিয়া মোল্যার স্ত্রী হেলেনা বেগম বলেন, বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছে প্রতিপক্ষরা। প্রতিপক্ষের ভয় ও আতঙ্কে একদন্ড কেউ বাড়িতে দাঁড়াতে পারে না। আমরা চার মাস ধরে বাড়িছাড়া। সাংবাদিক আসার কথা জানতে পেরে বাড়িতে এসেছি। আপনারা (সাংবাদিক) চলে গেলে, আবার বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র যেতে হবে।
জেসমিন খানম বলেন, আমার এক ছেলে কলেজে (এইচএসসি) এবং আরেক ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। কিন্তু প্রতিপক্ষের হামলা-মামলার ভয়ে চারমাস ধরে স্কুল, কলেজে যেতে পারছে না তারা। পড়ালেখা বন্ধ রয়েছে তাদের।
রেজাউল মোল্যার স্ত্রী হেমেলা জানান, তার ছেলে এ বছর এসএসসি পরীক্ষার্থী। কিন্তু বাড়িঘরে থাকতে না পারায় পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে পারছে না। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে কিনা সংশয় রয়েছে। প্রতিপক্ষের ভয়ে তার স্বামী ও ছেলে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের অর্থ-জমিজমা থাকা সত্ত্বেও লুটপাট করে নিয়ে যাওয়ায় আমি এখন পরের বাড়িতে থাকি। সেখানেই খাই।
মোল্যা শহিদুল ইসলাম জানান, সাংবাদিকরা পেড়লী গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর দেখে আসার পর প্রতিপক্ষের লোকজন আরো সহিংস হয়ে উঠেছে। পুরুষদের বাড়ি না পেয়ে, নারীদের বিভিন্ন ধরণের হুমকি দিচ্ছে।
এদিকে পেড়লী এলাকার বিপুল সংখ্যক লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করায় পেড়লী বাজারে ব্যবসা-বাণিজ্যেও ভাটা পড়েছে। অনেকে প্রতিপক্ষের ভয়ে বিভিন্ন দোকানসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারছেন না। এলাকার সাধারণ লোকজনও স্বাভাবিক ভাবে চলাচল করতে পারছেন না।
এ পরিস্থিতিতে এলাকার সচেতনমহল মনে করছেন পেড়লী গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পুলিশের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে। অশান্ত পেড়লীকে বসবাস যোগ্য করে তোলার জন্য সবার আন্তরিকতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
তবে এ বিষয়ে পেড়লী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জারজিদ মোল্যা দাবি করেন, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পেড়লী গ্রামে দুইপক্ষের সংঘর্ষে মোফাজ্জেল হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইউনিয়নের কোথাও কোনো বাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটেনি। এলাকার পরিবেশ স্বাভাবিক রয়েছে।
পেড়লী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এটিএম তসরিফুজ্জামান বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর যেসব বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছিল, সেই অবস্থায় রয়েছে। নতুন করে কোনো বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট হয়নি। এছাড়া আসামিরা জামিনে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
হাফিজূল নিলু/এফএ/জেআইএম