১৫ বছর ধরে সহস্রাধিক মানুষের আর্সেনিকযুক্ত পানির ব্যবহার

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি গাইবান্ধা
প্রকাশিত: ০৫:৩২ এএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

১৫ বছর ধরে প্রতিদিন আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছেন গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার পদুমশহর ইউনিয়নের মজিদের ভিটা গ্রামের সহস্রাধিক মানুষ। ফলে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। দেখা দিয়েছে বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ওই এলাকার মানুষ।

সাঘাটা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ও পদুমশহর ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১৫ বছর আগে মজিদের ভিটা গ্রামে প্রথম আর্সেনিক ধরা পড়ে। সুপেয় পানি পানের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের উদ্যোগে সেখানে রিংওয়েল ও তারাপাম্প স্থাপন করা হয়। কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো বিকল হয়ে পড়েছে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে মজিদের ভিটা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, আর্সেনিকের উপস্থিতি থাকায় টিউবওয়েলগুলোতে লাল রঙ এঁকে দেয়া হয়। কিন্তু সেই রঙ আর নেই। আর্সেনিকযুক্ত ওই টিউবওয়েলের পানি দিয়েই চলছে রান্নার কাজ, চলছে কাপড় ধোয়াসহ সাংসারিক অন্যান্য কাজ। এমনকী খাবার পানিও এসব টিউবওয়েল থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করায় গ্রামটির বেশ কয়েকজনের শরীরে ছোট ছোট কালো ফুটুনি (দাগ) ও সাদা দাগ দেখা গেছে।

gaibandha

মজিদের ভিটা গ্রামের কৃষক মো. শাহ আলম (৫৫) বলেন, আমার টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি থাকায় সেটির গায়ে লাল রঙ করে দেয়া হয়। এরপর কয়েকদিন ওই টিউবওয়েলের পানি খাওয়া বন্ধ রেখে দূরে এক প্রতিবেশির বাড়ি থেকে পানি সংগ্রহ করি। কিন্তু এভাবে কতদিন অন্যের বাড়ি থেকে পানি আনা যায়। পরে বাধ্য হয়ে নিজ টিউবওয়েলের আর্সেনিকযুক্ত পানিই সেবন করা শুরু করি।

একই গ্রামের কৃষক আল মামুন (৩০) বলেন, ২০ বছর আগে আমাদের গ্রামে আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়ে। কিন্তু এত বছর পার হলেও নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করেনি কেউ। ফলে বাধ্য হয়েই আমরা আর্সেনিকযুক্ত পানি সেবন করি।

তিনি বলেন, প্রথমে শরীরে কালো রঙের ফুটুনি (দাগ) হয়। পরে ফুটুনি বড় হতে থাকে। চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের কাছে গেলে জানতে পারি, আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়েছি। বেশি বড় হলে এসব ফুটুনি ব্লেড দিয়ে কেটে দেই। ওষুধ খেয়েছি, লোশন ও ক্রিম ব্যবহার করেছি কিন্তু কিছুতেই ভালো হচ্ছে না।

১১০ ফুটেরও বেশি গভীরে পাইপ বসানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও ভালো পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কী করব বলেন? বাধ্য হয়ে আর্সেনিকযুক্ত পানিই সেবন করছি- যোগ করেন তিনি।

gaibandha

গৃহিনী রেহানা বেগম (৫০) বলেন, আর্সেনিকযুক্ত পানি পানের ফলে আমার দুই ছেলের হাতের আঙুলে ঘা হয়েছে, চামড়া উঠে যাচ্ছে। ছেলেদের অনেক চিকিৎসা করিয়েছি, কিন্তু কিছুতেই কোনো উপকার হচ্ছে না। এখনও তাদের হাতে দাগ রয়েছে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের লোকজন টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা করে জানিয়েছেন পানিতে আর্সেনিক রয়েছে। উপায় না থাকায় আমরা আর্সেনিকযুক্ত পানিই খাচ্ছি- বলেন তিনি।

মজিদের ভিটা গ্রামের স্কুল শিক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, গ্রামের মানুষ চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। খুব দ্রুত নিরাপদ পানির ব্যবস্থা না করলে রোগটি মহামারি আকার ধারণ করবে।

তিনি স্থায়ীভাবে পানির ট্যাংক স্থাপন করে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান।

মজিদের ভিটা গ্রাম থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বোনারপাড়ায় সাঘাটা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কার্যালয়। সেখানে গিয়ে জানা যায়, গত ছয় মাস ধরে সেখানে আর্সেনিক পরীক্ষার কোনো মেডিসিন নেই। যা আছে তার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। মজিদের ভিটাসহ উপজেলার কতগুলো গ্রামের টিউবওয়েলে আর্সেনিকের মাত্রা বেশি সেই হিসাবও নেই জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে।

তবে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের স্থাপন করা ৪৬টি নলকূপের মধ্যে ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে ওই ইউনিয়নে দুটি নলকূপে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক ধরা পড়ে। এছাড়া সাঘাটা উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে ২০০৩ সালের ১ মার্চ থেকে ২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২৭৭৬টি নলকূপে আর্সেনিক পরীক্ষা করা হয়।

অধিদফতরের নলকূপ মিস্ত্রি (মেকানিক) মুনজিল মিয়া বলেন, প্রায় তিন বছর আমি মজিদের ভিটা গ্রামের দায়িত্বে ছিলাম। গ্রামটির অনেকগুলো টিউবওয়েলের পানিতে অতিরিক্ত মাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়ে। বিষয়টি ঢাকার অফিসকেও জানানো হয়। এ ব্যাপারে পরবর্তীতে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এছাড়া পাশের ঘুড়িদহ ইউনিয়নের পবনতাইড় গ্রামসহ আরও কয়েকটি গ্রামে আর্সেনিকের উপস্থিতি বেশি মাত্রায় পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।

gaibandha

মজিদের ভিটা গ্রামের ইউপি সদস্য মইচ উদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামের অনেকেই আর্সেনিকে আক্রান্ত। টিউবওয়েলগুলোতে আর্সেনিকের উপস্থিতি দেখা দেয়ায় কয়েকটি রিংওয়েল ও তারাপাম্প স্থাপন করা হয়। কিন্তু দেখভালের অভাবে সেগুলোও নষ্ট হয়ে গেছে। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরকে জানিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না।

পদুমশহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. তৌহিদুজ্জামান স্বপন বলেন, মজিদের ভিটা গ্রামের টিউবওয়েলগুলোতে আর্সেনিকের উপস্থিতি ধরা পড়ার পর বিভিন্ন সংস্থা থেকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য স্থায়ী একটি ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তারা আর এগিয়ে আসেনি। গ্রামটিতে সুপেয় পানির ব্যবস্থার জন্য আমরা যে স্থায়ী পানির ট্যাংক স্থাপন করব সেই অর্থও আমাদের ইউনিয়ন পরিষদে নেই। এটি স্থাপন করা গেলে পাইপের মাধ্যমে গ্রামের পরিবারগুলোতে সুপেয় পানি সরবরাহ করা যেত।

স্থায়ী পানির ট্যাংক স্থাপনের জন্য অর্থ বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

সাঘাটা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. তোফাজ্জল হোসেন এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে জাগো নিউজকে বলেন, আমার মূল পোস্টিং গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায়। এক মাস আগে আমাকে এখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মজিদের ভিটা গ্রামে আর্সেনিকের বিষয়টি আমার জানা নেই।

গ্রামটিতে যদি রিংওয়েলের বরাদ্দ থাকে তাহলে উপজেলা চেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে সেটি স্থাপন করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা জমা দিতে হবে বলেও জানান তিনি।

মজিদের ভিটা গ্রামে আর্সেনিকের উপস্থিতি এবং গ্রামটিতে সুপেয় পানির অভাব প্রসঙ্গে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পালকে অবহিত করা হলে মুঠোফোনে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। অনেক সময় গভীর নলকূপ স্থাপন করলে আর্সেনিকের মাত্রা কমে যায়। সেটাও স্থাপনে আমরা চেষ্টা করব।

ভালো ও উন্নতমানের নলকূপ স্থাপন করলে সেটা থেকে এলাকার অনেক মানুষ উপকার পেতে পারেন। আর যদি দেখা যায় সেভাবেও আর্সেনিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে না তাহলে বিকল্পভাবে পাশের এলাকা থেকে কীভাবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা যায়, সেই চেষ্টা আমরা করব। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দ্রুত সমস্যার সমাধানেও আমরা চেষ্টা করব- যোগ করেন জেলা প্রশাসক।

রওশন আলম পাপুল/এমএআর/আইআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।