নাক দিয়েও বাঁশি বাজান সোহরাব বয়াতি

ঝালকাঠি কলেজ মোড়ের কাউন্টারে থামানো যাত্রীবাহী বাসে উঠে একেক সময় একেক ধরনের ওষুধ বিক্রি করেন সোহরাব। সেইসঙ্গে নিজে গান লিখে, সুর করে নিজেই গান। তার বেশিরভাগ গানই দেশ ও প্রকৃতি নিয়ে। দেশ ও প্রকৃতির বাইরেও বাল্য বিয়ে, যৌতুক ও পরিবার পরিকল্পনাসহ সমাজ সংস্কারে স্থানীয় ভাষায় নিজের লেখা গান গেয়ে রাখছেন অবদান।
‘যৌতুক নেবো না যৌতুক দেবো না/যৌতুক করেছে মানা বাংলাদেশ সরকার/যৌতুকের অভিশাপ বড় ভয়ঙ্কর।’ কিংবা ‘ছোট ছোট ছেলে মেয়ে বিয়ে দিতে নাই/ মেয়ের বয়স ১৮ বছর কমপক্ষে চাই/২২ বছর ছেলের বয়সটা যদি থাকে ঠিক/দেখে শুনে দেবেন সবে বিবাহের তারিখ, ও ভাই বিবাহের তারিখ।’
বাউল সোহরাবের লেখা এসব গান হাট-বাজারে তো বটেই বরিশাল বেতারেও পরিবেশন হচ্ছে। তিনি বাউল শিল্পী হিসেবে বরিশাল বেতারে তালিকাভুক্ত। বেতার কর্তৃপক্ষ আগে-ভাগেই অনুষ্ঠানের বিষয় জানিয়ে দিলে তার ওপর গান লিখে নিজেই সুর করে পরিবেশন করেন সোহরাব। বাউল সোহরাবের নিত্যসঙ্গী সারিন্দা আর বাঁশের বাঁশি। সারিন্দা বাজিয়ে নিজের গান পরিবেশন করেন। অসাধারণ সুরে বাঁশিও বাজাতে পারেন তিনি। কেবল মুখ দিয়েই নয়, নাক দিয়েও বাঁশি বাজাতে পারেন, তুলতে পারেন যেকোনো সুর। তবে তা নিছক আনন্দ দেয়ার জন্য।
সারিন্দা বাজিয়ে নিজের গান করেন আর বাঁশি বাজান সহশিল্পীদের গানে। ‘ওরে গ্যাদার মা ভ্যাঁদা মাছটা মোর লইগ্যা রাহিস/ একটু অলুদ মরিচ বাইট্টা দিয়া ত্যালের উপর ছাইরা দিস/ ভ্যাঁদা মাছটা মোর লইগ্যা রাহিস।’ এমন ৩শ গানের রচয়িতা, সুরকার ও গায়ক বাউল কবি সোহরাব মিয়া নিজেই।
ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন জেলায় সোহরাব বয়াতি নামে পরিচিত অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি। যদিও প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেননি অভাবের তাড়নায়। সোহরাব মিয়ার আরেক অসাধারণ প্রতিভা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে স্থানীয় সংস্কৃতির গান। স্থানীয় ভাষায় সাংসারিক বিষয়ের ওপর গান গেয়ে তিনি আসর মাতিয়ে রাখেন।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার শেখেরহাট গ্রামের প্রয়াত ফজলে আলী হাওলাদারে ছেলে বাউল শিল্পী সোহরাব হোসেন (৫৫)। জীবিকার তাগিদে ৪০ বছর ধরে তিনি ফুটপাতে হকারি করে ভেষজ ওষুধ বেচে সংসার চলাচ্ছেন। আর মনের খোরাক জোগাতে গান লেখেন, নিজেই সুর করে গাইছেন। বাবা ফজলে আলীর কাছে গানের হাতেখড়ি সেই শৈশবে। শিশুকালে পালাগানের লোকজনের পাইলদার (সহযোগী) হিসেবে গান গেয়ে যাত্রা শুরু করেন সঙ্গীতাঙ্গনে। এখন বাউল সোহরাব দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ সমাদরে নানা অনুষ্ঠান আয়োজনে গান গাইতে ডাক পান।
বাউল সোহরাব বলেন, ‘গান আমার নেশা, রক্তের সাথে মিশে আছে। তাই অনুষ্ঠান আয়োজনে যে যেখানে ডাকেন সেখানেই যাই। আয়োজকরা ভালোবেসে যা দেয় তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি। তবে প্রযুক্তির যুগে হিন্দি আর ইংরেজি গানের দাপটে গ্রামবাংলার গান এখন হারাতে বসেছে। তাই সংসার চালাতে হকারি পেশাও ধরে রাখতে হয়েছে।’
ঝালকাঠির লোকজ সংস্কৃতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন কলেজ শিক্ষক ড. কামরুন্নেছা আজাদ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এত স্বল্প শিক্ষিত একজন মানুষ হয়েও বাউল সোহরাব যেসব গান লিখছেন তা আসলেই কল্পনা করা যায় না। সমাজের নানাবিধ সমস্যা সমাধানে কাব্যিক ছন্দে গান লিখে নিজেই সুর করে যাচ্ছেন। আর সমাজের অসংগতিকে করছেন গানে গানে কুঠারাঘাত। রেডিও থেকে শুরু করে ফুটপাতে এসব গান গেয়ে সমাজে অবদান রাখছেন সোহরাব। সত্যিই তিনি একজন দৃষ্টান্ত।’
১৫ শতাংশ জমিতে বসতবাড়ি সোহরাব মিয়ার। চাষের জমি নেই। ধার দেনা করে দুই মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর এখন ২ ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। বড় ছেলে জীবন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় অতি অল্প বেতনে চাকরি করছে। আর ছোট ছেলে সুজন নবম শ্রেণিতে পড়ে। অভাব দারিদ্র নিত্যদিনের সঙ্গী। তবু গান তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে জীবন যুদ্ধের ময়দানে। ভাঙা ঘরে চাঁদের আলোর মতোই বাউল সোহরাবের প্রতিভা দারিদ্র্যের কষাঘাতে আজ জর্জরিত। অভাব অনটন পিছু ছাড়ছে না। তবু বাউল কবি সোহরাব মিয়া আমৃত্যু আনন্দেই গান গেয়ে যাবেন বলে পণ করেছেন।
আতিকুর রহমান/এফএ/জেআইএম