করোনা দুর্যোগেও বিনা বেতনে সেবা দিচ্ছেন ক্ষিরোদ

মোসাইদ রাহাত
মোসাইদ রাহাত মোসাইদ রাহাত , সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি সুনামগঞ্জ
প্রকাশিত: ০৮:০৯ পিএম, ২২ এপ্রিল ২০২০

করোনাভাইরাস সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও চালাচ্ছে তাণ্ডব। প্রতিনিয়ত মানুষ করোনা উপসর্গ নিয়ে ছুটছেন হাসপাতালে। এছাড়া শরীর বেশি খারাপ হলে ক্লিনিক বা হাসপাতাল অথবা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে প্রয়োজন অ্যাম্বুলেন্স। ফোন করে হাসপাতালে জানালে জরুরি সেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে অ্যাম্বুলেন্স এবং এর চালক।

এমনই একজন অ্যাম্বুলেন্সচালক সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ক্ষিরোদ কুমার হাজং। একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে ২০১১ সালে অ্যাম্বুলেন্সচালক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু এখনও তার জীবন চলে অনিয়মিত সম্মানিতে। কারণ প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে উপজেলা পরিষদের সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে তাকে রেখে দেয়া হয়। তিনিও অন্য কোথাও না গিয়ে রয়ে যান নিজ জন্মস্থানে। টানা দু’বছর বিনা বেতনে চালিয়েছেন অ্যাম্বুলেন্স। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে তার জীবন চলছে কোনো রকমে। ঠিকমতো সম্মানী পান না গেল এক বছর। পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে থাকার চাইতে একটু ভয়েই থাকেন করোনা পরিস্থিতির সম্মুখসারির এ যোদ্ধা।

জানা যায়, সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভপুর উপজেলা ৫০ শয্যা হাসপাতালে ২০১১ সালে এমএনএইচআই’র একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে যোগদান করেন ক্ষিরোদ। ২০১১-১৬ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। পরবর্তীতে প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তিনি রয়ে যান বিশ্বম্ভরপুরে। কারণ ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার, আর বাবার ভিটে এখানেই। ২০১৭-১৮ সালে বিনা সম্মানীতে কাজ করেছেন দুই বছর। রোগী নিয়ে আসলে খুশি হয়ে যা দিত তা-ই রাখতেন। পরবর্তীতে উপজেলা পরিষদের মিটিংয়ে রেজুলেশনের মাধ্যমে উপজেলারবাসীর সেবার জন্য নিয়োগ দেয়া হয় ক্ষিরোদকে। বেতন অর্ধেকের চেয়েও কমিয়ে দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, নিয়ম অনুযায়ী উপজেলার সাত ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা এক হাজার করে এবং উপজেলার পরিষদের চেয়ারম্যান দুই হাজার টাকা করে দেবেন। কিন্তু বর্তমানে সেটিও অনিয়মিত। মন চাইলে কখনও তারা টাকা দেন, কখনও দেয়া-ই হয় না।

এক সেনা সদস্যের হাতে গাড়ি চালানো শেখা ক্ষিরোদের। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মার্কেন্টাইল ব্যাংকের গাড়িচালক হিসেবে কাজ করেন কয়েক বছর। পরবর্তীতে ওই এমএনএইচআই প্রজেক্টের সঙ্গে পরিচয়। সেখানকার সেনাবাহিনীর এক লেফটেন্যান্ট জেনারেলের গাড়ি চালিয়েছেন অনেক বছর। বর্তমানে করোনা উপসর্গ রোগী নিয়ে আসতে বা নমুনা পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয় উপজেলার একমাত্র অ্যাম্বুলেন্সটি। ক্ষিরোদকেও এ কাজে থাকতে হয় সার্বক্ষণিক সময়। একে তো বেতন অনিয়মিত অন্যদিকে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করা ক্ষিরোদের একটিই দাবি, তার চাকরিটা যেন সরকারিকরণ হয়।

ক্ষিরোদ কুমার হাজং জাগো নিউজ-কে বলেন, আমার কোন স্বার্থ নাই, শুধু দুঃখ চাকরিটা সরকারি হচ্ছে না। যদি সরকারি হয়ে যায় তাহলে ছেলে-মেয়ে, মা-বউ নিয়ে সুন্দরভাবে জীবনটা কাটাতে পারব। ছেলে রোজ বায়না ধরে ওকে সাইকেল কিনে দেয়ার জন্য, তাকেও সান্ত্বনা দেই দিচ্ছি-দেব বলে। কিন্তু কীভাবে দেব, বেতনই তো ঠিকমতো পাই না। ইউএনও ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা স্যার খুশি হয়ে মাঝে-মধ্যে যা দেন তা দিয়েই চলতে হয়, মাস্টার রোলে চাকরি হয়েও সেটার টাকা ঠিক মতো পাই না। তাছাড়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের পর তো কেউ প্রাপ্ত টাকাও দিতে চায় না।

hajang-02.jpg

তিনি আরও বলেন, সকলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক উপজেলার সাত ইউনিয়ন থেকে এক হাজার করে এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা করে সম্মানী দেয়ার কথা, কিন্তু সেটা দিচ্ছেন না কেউ। চাইতে গেলে বলেন, দিয়ে দেব। পরিবার চালানোর জন্য বাবার কিছু জমি আছে, সেখানে বোরো ধানের চাষাবাদ করি। একটি ছোটখাটো বাঁশের বাগান আছে। ফসল ঘরে উঠলে কয়েকটা দিন ভালো যায়, পরবর্তীতে ঋণ করে চলতে হয়। ইউএনও ও আরএমও স্যার আমাকে আদর করে হাত খরচের টাকা দেন। এরপরও যদি চাকরিটা সরকারি হয়, তাহলে একটু ভালোভাবে চলতে পারতাম।

ক্ষিরোদ কুমার বলেন, সময়-অসময় নেই, জরুরি কল পেলেই দৌড় দেই। নির্ধারিত স্থানে রোগী পৌঁছে দেই। যখনই ফোন পেয়েছি সেখানে দ্রুততার সাথে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি। সৎভাবে কাজ করার চেষ্টা করেছি। রোগীদের সেবা দেয়াই তো আমার ধর্ম। আমি আমার এই কাজকে অনেক ভালোবাসি তাই অনেক টাকার অফার পেয়েও অন্যত্র যায়নি। রোগী নিয়ে আসলে তারা খুশি হয়ে আমাকে এক-দুইশ টাকা দেন, এটা দিয়েই ঘরের খাবার আসে।

বর্তমান করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, করোনার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় যাই, একটু ভয় তো করেই। কারণ দিনশেষে আমাকে তো ঘরে ফিরতে হয়। আমার কারণে আমার পরিবারের যেন কিছু না হয় সেই প্রার্থনা করি সবসময়। আমার স্ত্রী রস্মীতা দেবী হাজং। সেও কিছুটা হাতের কাজ জানে। সেলাই করে ২০০-৩০০ টাকা পায়, এ নিয়ে আমাদের জীবন চলছে।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ জানান, অ্যাম্বুলেন্সের চালকের পদ শূন্য থাকায় টেম্পোরারি (অস্থায়ী) হিসেবে ক্ষিরোদ হাজং কাজ করছে। সে সৎ, নিবেদিত ও কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মী। বর্তমান সংকটে সে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। সংক্রমণের ভীতি থাকা সত্ত্বেও সে সম্মুখসারির একজন হিসেবে কাজ করছে। এলাকার লোকজন তার কাজে সন্তুষ্ট।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সফর উদ্দিন বলেন, হাজং অত্যন্ত ভালো ছেলে। তার সঙ্গে আমার এখনও তেমন একটা পরিচয় হয়নি। তাছাড়া তার যে সম্মানীর কথা বলা হচ্ছে, সেটি আমাকে কেউ এখনও জানায়নি। বিষয়টি জেনে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমীর বিশ্বাস বলেন, ক্ষিরোদ কুমার আমাদের উপজেলার সন্তান। সে অত্যন্ত সৎভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জরুরি রোগী আনার কাজে সে কখনও না বলে না। তার আচার-ব্যবহারে আমরা সন্তুষ্ট। সবদিক দিয়ে সে একজন ভালো মানুষ। আমিও তাকে অনেক পছন্দ করি। করোনা পরিস্থিতিতেও সে সাহসের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।