হতদরিদ্রদের টাকাতেও ভাগ!
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও হতদরিদ্র পরিবারগুলোকে ঈদ উপহার হিসেবে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই টাকা পাচ্ছে ৭৫ হাজার পরিবার। কিন্তু এই টাকাতেও ভাগ বসানোর অভিযোগ উঠেছে জেলার তিন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে।
ক্ষতিগ্রস্ত ও হতদরিদ্রদের তালিকায় নিজেদের ছেলে, ভাই-বোন, সামর্থ্যবান আত্মীয়-স্বজন, প্রবাসী ও বিত্তবানদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন তারা। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় ইতোমধ্যে দুই জনপ্রতিনিধিকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে সারাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত ও হতদরিদ্র ৫০ লাখ পরিবারকে ঈদ উপহার হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে দেয়া হচ্ছে। গত ১৪ মে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে একযোগে উপকারভোগীদের মোবাইল ব্যাংক হিসাবে এই অর্থ প্রেরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এরই মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৭৫ হাজার পরিবারের প্রায় অর্ধেকই টাকা পেয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। এই টাকা দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য, শিক্ষক ও সমাজের গণমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করেছে।
কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কবির আহমেদ, বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউপির চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন ভূঁইয়া ও কসবা উপজেলার মেহারী ইউপির চেয়ারম্যান মো. আলম মিয়া অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করে ছেলে, ভাই-বোন, সামর্থ্যবান আত্মীয়-স্বজন, প্রবাসী ও বিত্তবানদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ও হতদরিদ্র হয়েও প্রধানমন্ত্রীর উপহারের তালিকায় নাম ওঠেনি- এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকের। আবার অনেকে এই টাকা পেয়ে বেজায় খুশি হয়েছেন।
কসবা উপজেলার মেহারী ইউনিয়নের যমুনা গ্রামের রিকশা চালক মো. রুবেল জানান, করোনাভাইরাসের কারণে তিনি রিকশা চালাতে পারছেন না। পরিবার নিয়ে এখন অসহায় অবস্থায় আছেন। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের তালিকায় নাম তোলার জন্য চেয়ারম্যানকে একাধিকবার অনুরোধ করেও নিজের নাম তুলতে পারেননি তিনি। উল্টো চেয়ারম্যান তাকে ধমক দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন এই রিকশাচালক।
বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দুলালপুর গ্রামের বাসিন্দা শারীরিক প্রতিবন্ধী তাসলিমা জানান, প্রধানমন্ত্রীর উপহারের তালিকায় নিজের নাম তুলতে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি। চেয়ারম্যান তাকে তার ওয়ার্ডের মেম্বারের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। কিন্তু মেম্বারও তার নাম তুলতে সাহায্য করেননি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার ভাদুঘর এলাকার রং মিস্ত্রি রেনু মিয়া জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই তার কাজ বন্ধ। ধার-দেনা করে সংসার চলছিল। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহারের টাকা পেয়ে তার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি! দীর্ঘদিন ধরে মাছ-মাংস খেতে না পারায় টাকা পেয়েই মাছ কেনেন তিনি।
চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে তালিকা তৈরিতে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রশাসন। তদন্ত কমিটি ইউপি চেয়ারম্যান কবির আহমেদ, জামাল উদ্দিন ভূইয়া ও আলম মিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পায়।
তদন্ত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে বিষ্ণুপুর ও বীরগাঁও ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি দেন জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা খাঁন। পরবর্তীতে ২৮ মে ওই দুইজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ। আর মেহারী ইউপির চেয়ারম্যান আলম মিয়ার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পেয়ে গত সোমবার (৮ জুন) জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্তে চেয়ারম্যান আলম মিয়া তালিকায় তার ছেলে ও আপন ভাইসহ নয়জন নিকট আত্মীয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক হায়াত উদ-দৌলা খাঁন জানান, ঢাকা থেকে সার্ভারের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে টাকা পাঠানো হচ্ছে। যেগুলো বাদ দেয়ার সেগুলো আমরা ইতোমধ্যে চিঠি লিখে দিয়েছি এবং বাদও হয়েছে। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
আজিজুল সঞ্চয়/আরএআর/পিআর