করোনায় কমেছে পূজামণ্ডপ, ছোট হয়েছে প্রতিমার আকার
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিবছর দুর্গাপূজায় সাড়ে তিন থেকে চার কোটি টাকা মূল্যের প্রতিমা তৈরি হয়। পূজামণ্ডপের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিমা তৈরির আর্থের পরিমাণও বেড়ে যায়। পূজার আগে মাত্র দুই মাস কাজ করে এক-দেড় কোটি কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেন মৃৎশিল্পীরা।
কিন্তু মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে এবার সংকুচিত হয়ে পড়েছে প্রতিমা তৈরির ব্যবসা। পূজামণ্ডপের সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনি প্রতিমার আকারও ছোট করা হচ্ছে। এতে করে এবার প্রায় দুই কোটি টাকার প্রতিমা তৈরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মৃৎশিল্পীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন উপজেলার কুমারপাড়ায় কয়েকশ মৃৎশিল্পী রয়েছেন। তারা সবাই মাটি দিয়ে হরেক রকমের জিনিসপত্র তৈরি করেন। কিন্তু দুর্গাপূজাসহ অন্যান্য পূজার প্রতিমা তৈরি করেন ৫০ জনের মতো মৃৎশিল্পী।
জেলায় প্রতিবারই জাঁকজমকভাবে উদযাপিত হয় হিন্দু ধর্মালম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। পূজার অন্তত দুই মাস আগ থেকেই প্রতিমা তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন শিল্পীরা। একেকটি মণ্ডপের জন্য সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে দুই-তিন লাখ টাকা পর্যন্ত মূল্যের প্রতিমা তৈরি করা হয়। মূলত আকার ও চাকচিক্য অনুযায়ী নির্ধারিত হয় প্রতিমার মূল্য।
তবে অদৃশ্য করোনাভাইরাসের থাবায় প্রতিমা তৈরির ব্যবসাও এবার মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিগত বছরের তুলনায় পূজামণ্ডপের সংখ্যা যেমন কিছুটা কমেছে, তেমনি আগের তুলনায় প্রতিমার আকারও ছোট হয়েছে। এবার থাকছে না পূজামণ্ডপের চাকচিক্যও। জেলায় এবার ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা মূল্যের প্রতিমা তৈরি হচ্ছে।
তবে ছোট প্রতিমা তৈরিতে পরিশ্রম বেশি হয় বলে জানিয়েছেন শিল্পীরা। এর ফলে শ্রমিকদের মজুরিসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিটিয়ে এবার লাভের চেয়ে লোকসানের শঙ্কা শিল্পীদের।
কয়েকজন মৃৎশিল্পী জানান, ২০১৮ সালে ৫৭৬টি এবং ২০১৯ সালে ৫৮০টি পূজামণ্ডপের জন্য প্রতিমা তৈরি করেছিলেন তারা। বিগত দুই বছরে সাড়ে তিন থেকে চার কোটি টাকার প্রতিমা তৈরির বাণিজ্য হয়েছিল। প্রতিমা তৈরি থেকে প্রতিবারই দেড়-দুই কোটি টাকা মুনাফা হয় শিল্পীদের। আর লাভের এই অর্থ দিয়েই সারাবছর মৃৎশিল্পের ক্ষতি পুষিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। এবার ৫৫৭টি মণ্ডপের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের প্রতিমা তৈরি করা হচ্ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের নোয়াপাড়া এলাকার মৃৎশিল্পী হিমাংশু পাল বলেন, আমি প্রায় দুই যুগ ধরে প্রতিমা তৈরির কাজ করছি। বিগত দুই বছরের দুর্গাপূজায় আমি ৬০টি মণ্ডপের জন্য ৩০ লাখ টাকার প্রতিমা তৈরি করেছিলাম। তখন গড়ে প্রতিটি প্রতিমার দাম ছিল ৫০ হাজার টাকা। কয়েকটি মণ্ডপের জন্য এক-দেড় লাখ টাকা দামের প্রতিমাও বানিয়ে দিয়েছিলাম। তখন সব খরচ বাদ দিয়ে অর্ধেকের মতো লাভ হয়েছিল।
তিনি বলেন, এবার লাভের আশা না করে খরচ তোলার চিন্তায় আছি। প্রতিমার আকার বিগত বছরের তুলনায় অর্ধেক ছোট হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা দামের ২০টি প্রতিমা তৈরির অর্ডার পেয়েছি। শ্রমিকরা ছোট প্রতিমা তৈরির জন্য মজুরি বেশি নিচ্ছেন, কারণ ছোট প্রতিমা তৈরিতে পরিশ্রম অনেক বেশি।
শহরের পাওয়ার হাউজ রোড এলাকার আরেক মৃৎশিল্পী ঝণ্টু পাল বলেন, প্রতিবছরই আট-দশ লাখ টাকার প্রতিমা তৈরি করি। এবার মাত্র লাখ তিনেক টাকার অর্ডার পেয়েছি। তাও পূজা শেষ হওয়ার পর প্রতিমার দাম পাবো। এবছর প্রতিমার আকারের সঙ্গে আমাদের ব্যবসার পরিধিও সীমিত হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, বিগত বছরগুলোতে শহরের বিভিন্ন বড় পূজামণ্ডপের জন্য প্রতিমা তৈরি করেছিলাম। এবার জেলার কোথাও বড় মণ্ডপ নেই। ছোট ছোট ১৬টি মণ্ডপের জন্য প্রতিমা তৈরির অর্ডার পয়েছি। প্রতিমাগুলোর গড় মূল্য ২০-২৫ হাজার টাকা করে হবে। সারা বছরের সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছে করোনাভাইরাস।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সদস্য ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা সুজন দত্ত বলেন, প্রতিবার অনেক জাঁকজমপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা উদযাপিত হয়। তিন-চার কোটি টাকা মূল্যের প্রতিমা তৈরি হয় মণ্ডপগুলোরে জন্য। কিন্তু এবার মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে পূজার সব আনুষ্ঠানিকতাই সীমিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এবার বিগত সময়ের তুলনায় প্রতিমার আকার ছোট করা হয়েছে। জেলার কোথাও বড় পূজামণ্ডপ হচ্ছে না। মণ্ডপগুলোর জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ ১১ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রাত ১০টার পর কোনো দর্শনার্থী মণ্ডপে প্রবেশ করতে পারবেন না। এছাড়াও মণ্ডপে দর্শনার্থীদের জন্য স্যানিটাইজেশন ব্যবস্থা রাখারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
আজিজুল সঞ্চয়/আরএআর/পিআর