করোনা শনাক্তে ‘সাইবারগ্রিন পদ্ধতি’ উদ্ভাবন, খরচ ১৪০ টাকা
কম খরচে করোনাভাইরাস শনাক্তে ‘সাইবারগ্রিন পদ্ধতি’ উদ্ভাবন করেছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) একদল গবেষক। এই পদ্ধতিতে করোনা শনাক্ত করতে প্রতি নমুনার জন্য বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ১৪০ টাকার মত খরচ হবে। এরমধ্যে আরএনএ এক্সট্রাকশন কিট ১০ টাকা, আরটি-পিসিআর কিট ১২০ টাকা, প্রাইমার ৩ টাকা ও অন্যান্য ৭ টাকা।
এ পরীক্ষায় সময় লাগবে মাত্র ৯০ মিনিট। একটি মাত্র টিউবেই এ পদ্ধতিতে করোনার বর্তমান ধরণগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
সোমবার (১০ মে) দুপুরে যবিপ্রবির প্রশাসনিক ভবনের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও জিনোম সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন নতুন এ উদ্ভাবনের ঘোষণা দেন।
লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘পরীক্ষা করে দেখা গেছে- সাইবারগ্রিন পদ্ধতিতে করোনা শনাক্তের সেনসিটিভিটি প্রচলিত অন্যান্য কিটের সমপর্যায়ের। এই গবেষণাটি প্রিপ্রিন্ট আকারে ‘medrxiv’ সার্ভারে পাওয়া যাচ্ছে এবং একটি পিয়ার রিভিউড জার্নালে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের সহায়তা পেলে আমরা এই গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে খুব সহজে এবং কম খরচে করোনা শনাক্তের কাজটি আমাদের দেশে করতে সক্ষম হব।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ও জিনোম সেন্টারের সহযোগী পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল কবীর জাহিদ বলেন, ‘বায়ো-ইনফরমেটিক্স টুলের মাধ্যমে আমরা দেখেছি বর্তমানে সংক্রমণশীল করোনার বিভিন্ন ধরণ শনাক্ত করা সম্ভব। শতাধিক নমুনা পরীক্ষা করে এর কার্যকারিতা যাচাই করা হয়েছে।’
বাংলাদেশের ব্যাংকনোটে করোনা ভাইরাসের আরএনএর উপস্থিতির বিষয়ে এক গবেষণাপত্রের সূত্র ধরে অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের গবেষক দল দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রাপ্ত ব্যাংকনোটে ভাইরাসের আরএনএর উপস্থিতি পেয়েছেন। গবেষক দল ব্যাংকনোটে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত ভাইরাসের এন-জিনের উপস্থিতি এবং ৮-১০ ঘণ্টা পর্যন্ত ওআরএফ জিনের স্থায়িত্ব শনাক্ত করতে পেরেছেন। এই গবেষণাপত্রটি এরইমধ্যে একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।’
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সংক্রমণশীল নতুন ধরন আমাদের মধ্যে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যশোর সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় এবং সাম্প্রতিক সময়ে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আমাদের গবেষক দল সাম্প্রতিক নমুনাগুলো থেকে ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টগুলো হোল জিনোম সিকোয়েন্সিং এবং স্পাইক প্রোটিনের সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে চিহ্নিত করেছেন। এরইমধ্যে পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স জিএসআইডি ডাটাবেজে জমা দেয়া হয়েছে।’
তিনি জানান, যশোর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল থেকে ভারত থেকে আসা ১৬ জনের নমুনা যবিপ্রবির জেনোম সেন্টারে পাঠানো হয়, যার মধ্যে তিন জনের করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়। পজিটিভ তিনজনের মধ্যে দুজনের শরীরে করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত করা হয়েছে। ভারতীয় এ ধরনটি বি ১.৬১৭.২ নামে পরিচিত, যার মধ্যে স্পাইক প্রোটিনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মিউটেশন রয়েছে।’
তিনি উল্লেখ করেন, যবিপ্রবির জিনোম সেন্টারে গতবছর ১৭ এপ্রিল হতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিনোম সেন্টারে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা শুরু করে এরমধ্যে ৪০ হাজারের অধিক নমুনা পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে এবং করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে ৮ হাজার ১০০ জনের।
অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, ‘আমাদের গবেষকরা গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে এই অঞ্চলে সংক্রমণ সৃষ্টিকারী ১০০টির মতো ভাইরাসের নমুনার স্পাইক প্রোটিন সিকুয়েন্স করেছেন। বিগত দুই মাসের ভাইরাসগুলোর মধ্যে উচ্চ সংক্রমণ ক্ষমতা সম্পন্ন সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের সংখ্যা সবচাইতে বেশি। এ ছাড়া বিগত দুই মাসের নমুনায় আমরা সাউথ আফ্রিকান, মেক্সিকো, ক্যালিফোর্নিয়া, ইউকে এবং নিউইয়র্ক ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পেয়েছি। এ ছাড়া আমরা স্পাইক প্রোটিনে কিছু বিরল মিউটেশন পেয়েছি যা এই অঞ্চলে এখনো দেখা যায়নি। সে মিউটেশনগুলোর প্রভাব নিয়ে আমরা কাজ করছি। এ ধরনের মিউটেশনগুলো সংক্রমণ ক্ষমতার ওপর কিংবা রোগের ভয়াবহতার ওপর কেমন প্রভাব ফেলতে পারে তা নিয়ে গবেষণা চলছে এবং শিগগিরই সে গবেষণার ফলাফল আমরা প্রকাশের জন্য উন্মুক্ত করব।’
গোটা বিশ্বেই এই ভাইরাস নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘করোনাকালের অবসান কবে হবে তাও এখন অনিশ্চিত। আমাদের দেশে যেমন করোনা শনাক্ত, করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, করোনার টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করা জরুরি, ঠিক তেমনি পরিবর্তনশীল এই ভাইরাস নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণাও জরুরি বলে আমরা মনে করি। একটি নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নিজস্ব ল্যাবে করোনা পরীক্ষার পাশাপাশি চলমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের সৃজনশীল গবেষণা করা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য।’
ভবিষ্যতে বিএসএল-৩ ল্যাবরেটরি স্থাপন করে ভ্যাকসিন তৈরিসহ আরও উচ্চমানের গবেষণা করতে আমাদের গবেষণা দল প্রস্তুত আছে বলেও জানান তিনি।
অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘জাতির এ মহাদুর্যোগকালে যশোর ও যশোর সংলগ্ন মাগুরা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার করোনা সন্দেহভাজনদের নমুনা শনাক্তের কাজ করে আমরা সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’
সাংবাদিক সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সেলিনা আক্তার, পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শিরিন নিগার, বায়ো-মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাসান মো. আল-ইমরান, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শোভন লাল সরকার, গবেষক তনয় চক্রবর্তী প্রমুখ।
মিলন রহমান/এসজে/এএসএম