‘মস্তিষ্ক হ্যাকের’ অভিযোগ কক্সবাজারের হারুনের, আসলে কি সম্ভব?

সায়ীদ আলমগীর
সায়ীদ আলমগীর সায়ীদ আলমগীর কক্সবাজার
প্রকাশিত: ০৫:৪৪ পিএম, ২৬ নভেম্বর ২০২১
হারুনুর রশিদ অভিযোগ করেছেন, এমআরআই পরীক্ষায় তার মাথায় নিউরো চিপ শনাক্ত হয়েছে

‘মস্তিষ্ক হ্যাক’ করেছে হ্যাকাররা, দাবিকৃত অর্থ না দিলে মুছে দেওয়া হবে মস্তিষ্কের সব স্মৃতি। শুনলে মনে হতে পারে হলিউড বা বলিউডের কোনো সিনেমার কল্পিত কাহিনি। কিন্তু এমনই এক অভিযোগ করেছেন কক্সবাজারের মো. হারুনুর রশিদ নামের এক যুবক। তার দাবি, হ্যাকাররা ইতোমধ্যে তার ব্যাংক হিসাব ক্লোন করে বিপুল অংকের অর্থও হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত তাকে সাইবার নির্যাতন করছে। ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে’ মস্তিষ্ক থেকে সব স্মৃতি ‘মুছে ফেলার’ হুমকিও দিচ্ছে তারা।

এই অভিযোগে সন্দেহভাজন দুইজনকে অভিযুক্ত করে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলাও করেছেন তিনি। অভিযোগকারী হারুনুর রশিদ (৩৩) কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবার ডেইল ইউনিয়নের সিকদার পাড়ার বাসিন্দা এবং ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য (মেম্বার)।

অবশ্য তার অভিযোগ অনুসারে, মস্তিষ্ক আসলে হ্যাক করা সম্ভব কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যদিও জিডি এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তারাও ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন ‘কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং’ বলে উল্লেখ করছেন।

হারুন দাবি করেন, বছর তিনেক আগে শ্বশুরবাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় তার শ্যালিকা আসমা উল হোসনার সহযোগিতায় হ্যাকার চক্রটি ইনজেকশন পুশ করে তার মাথায় একটি ছোট ইলেকট্রিক যন্ত্র (কম্পিউটার ডিভাইস) বা নিউরো চিপ স্থাপন করে। এর আগে তাকে চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে কিছু একটা খাইয়েছেন তার শ্যালিকা।

jagonews24এই এমআরআই পরীক্ষার রিপোর্ট দেখিয়ে হারুন বলছেন, তার মাথায় নিউরো চিপ শনাক্ত হয়েছে

হারুনের অভিযোগ, চা পানের পর আনুমানিক চার-পাঁচ ঘণ্টা অচেতন হয়ে ঘুমে থাকেন তিনি। ঘুম থেকে জেগে খেয়াল করেন মাথায় হালকা চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। হাত দিয়ে অস্তিত্ব পান হালকা রক্তপিণ্ডের। এরপরই তিনি শ্যালিকা আসমা উল হোসনাকে মাথা দেখিয়ে কী হয়েছে দেখতে বলেন। তখন শ্যালিকা নির্বিকার চিত্তে জবাব দেন, কোনো পোকার কামড়ে বা কোনো কারণে হয়তো একটুখানি রক্তের মতো দেখা যাচ্ছে।

এই ইউপি মেম্বার বলেন, ‘ঘটনার পরদিন থেকে আমি একজন খুব পরিচিত কণ্ঠের গায়েবি আওয়াজ শুনতে পাই। গায়েবি আওয়াজে আমাকে গালিগালাজ করা হচ্ছিল। আমার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক এলোমেলো হয়ে যায়। ব্যবহৃত আইফোনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডাউনলোড হয় পাবজিসহ পাঁচটি গেমস। কয়েক দফায় আমার ব্যাংক হিসাব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ গায়েব হয়ে গেছে। এরপর ক্রমাগতভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। একান্ত আপনজনদের কেউই আমার এসব ভূতুড়ে বিষয় বিশ্বাস করেনি, বরং হাসি-ঠাট্টার রসদ বানায় আমাকে।’

‘পরে পরিচিত একজন আইটি বিশেষজ্ঞকে আমার আইফোনের বিচিত্র আচরণ ও ফেসবুকের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণহীনতার বিষয়টি জানালে তিনি অ্যাপল, গুগল এবং ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে সন্দেহের বিষয়টি জানাতে বলেন। সে মোতাবেক তাদের কাছে বার্তা পাঠাই। এ পর্যায়ে নিশ্চিত হই অ্যাপল আইডি হ্যাক করে আমার ফোনের আইটিউনসহ যাবতীয় সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করছে হ্যাকাররা।’

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা লো ফ্রিকোয়েন্সির মাইক্রোচিপ শনাক্তকারী ডিভাইস দিয়ে মাথায় নিউরো চিপের অস্তিত্ব শনাক্ত করা গেছে দাবি করে হারুন বলেন, এ শনাক্তকরণ ডিভাইসটি AGPTek CC308+ Anti-Spy Signal Bug RF Detector মডেলের। বিদেশি একজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একাধিকবারের চেষ্টায় এমআরআই টেস্টে মাথায় ওই চিপ ধরা পড়ে।

হারুন দাবি করেছেন, তার এমআরআই পরীক্ষা চট্টগ্রামের এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেডে করেছেন এবং সেই টেস্টেই মাথায় ডিভাইস শনাক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে ওই হাসপাতালে যোগাযোগ করলে প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) কাউসার আলম জাগো নিউজকে বলেন, হাসপাতালের সংরক্ষিত তথ্যভান্ডারে হারুনুর রশিদ নামে ওই রোগীর এমআরআই পরীক্ষার ‘সঠিকতা’ রয়েছে। হাসপাতালের পরিচালক ডা. এনামুল হকের রেফারেন্স তিনি এমআরআই করান এবং তার রিপোর্ট পর্যালোচনা লেখেন এমআরআই বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. দিদারুল আলম।

jagonews24এই এমআরআই পরীক্ষার রিপোর্ট দেখিয়ে হারুন বলছেন, তার মাথায় নিউরো চিপ শনাক্ত হয়েছে

হারুনের অভিযোগ, তিনি কোনো অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন হাতে নিলে তার শরীর হালকা কেঁপে ওঠে। তার হাতের স্পর্শের পরপরই ফোনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাবজি গেমসসহ চার থেকে পাঁচটি ক্ষতিকর গেমস ডাউনলোড হয়ে যায়। হারুনের হাত দিয়ে স্পর্শ করা স্মার্টফোনটি মুহূর্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির বা ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে বলে ধারণা তার। এতে ফোনে থাকা যাবতীয় ডকুমেন্ট ও সব ধরনের তথ্য সহজে হ্যাকাররা পেয়ে যাচ্ছে। তবে তার নিয়ন্ত্রণ করা ফোন ও কম্পিউটার থেকেও কিছু তথ্য জব্দ করতে সক্ষম হয়েছেন হারুন।

হারুনের দাবি, কুতুবদিয়া উপজেলার বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আতিকুর রহমান নামের এক শিক্ষার্থী তার শ্যালিকা আসমা উল হোসনার সহযোগিতায় মাথায় ওই চিপ স্থাপন করে তার ব্রেইন হ্যাক করেছেন এবং তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ক্লোন করে প্রায় ২০ লাখের বেশি টাকা উত্তোলন করে ফেলেছেন।

হারুনের ভাষ্যমতে, বিদেশি একটি মাথার ব্রেইন হ্যাকার চক্র বাংলাদেশে রয়েছে। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে দেশীয় কিছু হ্যাকার। যারা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিপ (ক্ষুদ্র কম্পিউটার ডিভাইস) টার্গেট করা ব্যক্তিদের শরীরে স্থাপন করে এবং যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অর্থও লুটে নিচ্ছে। আতিকুর রহমান ওই দলের একজন।

আতিকুরের মাথায়ও এমন নিউরো চিপ রয়েছে দাবি করে হারুন বলেন, হ্যাকারদের সঙ্গে ব্রেইন টু ব্রেইন কথা বলতে সক্ষম হচ্ছেন আতিকুর। তাদের মধ্যে নিয়মিত কথাও হচ্ছে। তাই হারুনের প্রত্যেকটি কথা শোনার পাশাপাশি তার গতিবিধি নজরদারি এবং দৈনন্দিন সব কার্যক্রম সম্পর্ক জানতে পারছেন হ্যাকাররা।

হারুন দাবি করেন, সম্প্রতি এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করে তাকে অপারেশন করে মাথা থেকে ওই নিউরো চিপ ফেলে দেওয়ার প্রস্তাব দেন হ্যাকার আতিকুর রহমান। তা না হলে তার মস্তিষ্ক থেকে সব কিছু মুছে ছেলে পঙ্গু করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আতিকুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলেও এত এক্সপার্ট নই। কোনো হ্যাকার চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগও নাকচ করেন তিনি।

থানায় জিডির পাশাপাশি ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেছেন জানিয়ে হারুন দাবি করেন, প্রথমে মামলাটি ভুয়া ও হাস্যকর উল্লেখ করে নিতে চাননি আদালত। পরে তার (হারুনের) কথা শোনার পর মামলাটি গ্রহণ করে পুলিশের ঢাকার গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি) তদন্তের ভার দেওয়া হয়।

jagonews24এপিক হেলথকেয়ার লিমিটেড থেকে পাওয়া হারুনের এমআরআই পরীক্ষার রিপোর্ট

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শামীম জাগো নিউজকে বলেন, বাদীর ফোনটি ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য পাঠানোর আগ মুহূর্তে লস মুডে চলে যায়। বিবাদীর একটি মোবাইল সেট জব্দ করা হয়েছিল, ফোনে তেমন কিছুই না পাওয়ায় মামলাটি নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া যায়নি। তবে ভিকটিমের মাথায় যেহেতু এখন নিউরো চিপের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ভিকটিম হারুন চাইলে মামলাটি আবার পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন।

হারুনের অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এসব সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দেশে এ ধরনের অভিযোগ ইতিপূর্বে আর কেউ করেনি উল্লেখ করে ঘটনাটি তদন্তের সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তবে সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে কক্সবাজারের সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়।

ভিকটিম হারুনকে নিয়ে কক্সবাজার সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ফয়সাল আহমেদের সঙ্গে দেখা করে সবিস্তার আলোচনা করা হয়। সব কিছু শোনার পর তিনি বলেন, আমি সিআইডির ক্রাইম বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তাই এ বিষয়ে কাজ করা বেশ কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং।

তিনি বলেন, সিআইডি ক্রাইম বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করে বিষয়টি উদঘাটনের চেষ্টা করা হবে। একইসঙ্গে দায়ের করা মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার পরামর্শ দেন তিনি।

এদিকে হারুনের অভিযোগ অনুসারে, মস্তিষ্ক হ্যাক আসলে সম্ভব কি না তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ শামশুল ইসলাম খান বলেন, ব্রেইন হ্যাকের বিষয়টি অবিশ্বাস্য এবং হলিউড-বলিউডের মুভির কোনো গল্পের মতোই মনে হচ্ছে।

অবশ্য ২০১৩ সালের পর থেকেই ব্রেইন হ্যাকিংয়ের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আদালতে একাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলার নথিপত্র পাওয়া গেলেও সর্বশেষ ফলাফল কী হয়েছে তা জানা যায়নি।

মানুষের স্নায়ু-সংকেত নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি আয়ত্তে আসায় মস্তিষ্ক হ্যাক হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলে সতর্ক করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে কয়েক বছর আগে প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট মাদারবোর্ডের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, দ্রুত নিরাপত্তা অবকাঠামো তৈরি করতে হবে, যেন আমাদের মস্তিষ্ককে আমাদের বিরুদ্ধে কেউ কাজে লাগাতে না পারে। এটা ঠেকাতে হবে।

সায়ীদ আলমগীর/এইচএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।