ভোলার কুলসুম যেভাবে হলেন সুইজারল্যান্ডের ম্যারিও
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার চটিয়া গ্রামের মো. ইউসুফ হোসেন পেশায় ছিলেন গ্রাম্য কবিরাজ। গ্রামের হাট-বাজারে ওষুধ বিক্রি করে চার মেয়ে, দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে চলতো তার সংসার। আর্থিক সংকট থাকলেও ইউসুফের সংসারে সুখ ছিল। কিন্তু সেই সুখ বেশি দিন টেকেনি।
১৯৭৩ সালের দিকে হঠাৎ অজানা রোগে মারা যান ইউসুফ। এরপর ছয় সন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েন স্ত্রী মাফিয়া বেগম। তখন তিনি সন্তানদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। পরে তার ছোট দেবর মো. আব্দুল রব; মাফিয়া ও তার সন্তানদের নিয়ে যান রাজধানী ঢাকায়। আর সেখান থেকে ঘটনাক্রমে ভোলার সেই ইউসুফ হোসেনের মেয়ে কুলসুম হয়ে ওঠেন সুইজারল্যান্ডের ম্যারিও সিমো ভ্যামৌ। সম্প্রতি কুলসুম বাংলাদেশে এসে তার মাসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের খুঁজে বের করেছেন।
তবে বাংলাদেশি কুলসুম কীভাবে সুইডিশ ম্যারিও হলেন সে বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছেন জাগো নিউজের এই প্রতিবেদক। এ বিষয়ে কথা হয় কুলসুমের চাচা মো. আব্দুল রবের সঙ্গে।

তিনি জানান, তাদের পৈত্রিক বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের চটিয়া গ্রামে। স্বাধীনতার পর ঢাকায় একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতেন আব্দুল রব। তার বড় ভাই ইউসুফ মারা যাওয়ার আটদিন পর খবর পান তিনি। এরপর গ্রামের বাড়ি যান। গিয়ে দেখেন তার ভাবি মাফিয়া বেগম ছয় সন্তান নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। পরে তিনি তাদের বাজার করে দিয়ে আবারও ঢাকায় চলে যান। এর এক বছর পর তিনি মাফিয়া বেগম ও তার ছয় সন্তানদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। এরপর তিনি ঢাকার মোহাম্মদপুরের কাটপট্টিতে ৩০ টাকায় একটি বাসা ভাড়া নেন। পরে অভাবের কারণে মাফিয়া বেগম তার বড় দুই মেয়ে মিলন বেগম ও নিলুফা বেগমকে স্থানীয় বাসা-বাড়িতে কাজে দেন এবং দুই ছেলেকেও দোকানে কাজে দেন। তারপরও ঠিকমতো সংসার না চলায় স্থানীয় লোকজনের কথামতো কুলসুম ও ছোট মেয়ে সমনেহা সুমিকে মোহাম্মদপুরে এফএফসি নামে একটি এতিমখানায় দেন। তখন কুলসুমের বয়স ৬/৭ বছর ও সুমির বয়স তিনবছর। এতিমখানায় দেওয়ার ৩/৪ দিন পর দুই বোন পালিয়ে আসে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। পরে এতিমখানার দুই নারী এসে তাদের নিয়ে যান।
আব্দুল রব বলেন, আমার ভাতিজি কুলসুম ও সুমিকে যে ভাবি এতিমখানায় দিয়েছে সেটা শুরুতে জানতাম না। পরে আমি জানতে পেরে ভাবিকে নিয়ে প্রতি শুক্রবার তাদের দেখতে যাই। প্রায় ৩/৪ মাস পার হয়ে যায়। পরে এক শুক্রবার আবার আমরা তাদের দেখতে গেলে সেখানে আর তাদের পাইনি। এরপর খুঁজেও আর তাদের কোনো সন্ধান পাইনি।
যেভাবে ভোলার মেয়ে কুলসুম হয়ে গেলেন ম্যারিও সিমো ভ্যামৌ
১৯৭৭ সালের ১৯ জুলাই ওই এতিমখানা থেকে টিডিএইচ নামে একটি সংস্থার মাধ্যমে কুলসুম ও তার ছোট বোন সুমিকে দত্তক নেন সুইজারল্যান্ডের বার্থেলেনি। পরে সুইজারল্যান্ডে গেলে তার পালিত বাবা-মা কুলসুমের নাম দেন ম্যারিও সিমো ভ্যামৌ।

যেভাবে বাংলাদেশে ফিরে মা-ভাইবোনদের খুঁজে পেলেন কুলসুম
২০২১ সালের জানুয়ারিতে মায়ের সন্ধানে বাংলাদেশে আসেন কুলসুম। এরপর পরিচয় হয় ঢাকার সাংবাদিক মনজুরুল করিমের সঙ্গে। তিনি কুলসুমকে নিয়ে প্রতিবেদন করতে থাকেন। আর ওই প্রতিবেদন চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কুলসুমের পরিবারের চোখে পড়ে। এরপর যোগাযোগ করেন ওই সাংবাদিকের সঙ্গে। পরে বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে এবং ডিএনএ পরীক্ষা করিয়ে প্রায় ১৫ দিন আগে মায়ের কাছে ফেরেন কুলসুম। আর দীর্ঘ ৪৫ বছর পর কুলসুমকে পেয়ে আনন্দিত তার মাসহ পরিবারের সব সদস্যরা।
যেভাবে গ্রামের বাড়ি ভোলায় ফিরলেন কুলসুম
ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ি থেকে চাচার সঙ্গে ঢাকায় আসার কথা মনে আছে কুলসুমের। কিন্তু সেই থেকে কুলসুমের পরিবার ঢাকায় থাকেন। আর কখনোই গ্রামের বাড়ি যাননি তারা। পরিবারের সবাইকে ফিরে পেয়ে এবার কুলসুমের মনে পড়েছে তার শিশুকালের গ্রামের বাড়ির কথা। কিন্তু তিনি মনে করতে পারছিলেন না সেটা কোথায়। পরে তার মায়ের কাছে গ্রামের বাড়ির কথা শুনে কুলসুম তার স্বামী সুইজারল্যান্ডের নাগরিক আন্দ্রে সিমন ভারমুটকে নিয়ে গত বুধবার (২০ এপ্রিল) ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের চটিয়া গ্রামে আসেন। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ছিলেন সেখানে। আর কুলসুম আসার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছুটে আসতে শুরু করেন লোকজন। সকালে কুলসুম ও তার স্বামী গ্রামের বাড়ি পৌঁছালে পরিবারের সদস্যরা ফুল দিয়ে তাদের বরণ করেন। এরপর কুলসুম তার বাবার কবর জিয়ারত করেন। পরে দুপুর ১টার দিকে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন তিনি।
এমআরআর/এএসএম