‘ডাটা এন্ট্রির কাজ আমার সঙ্গে যায় না, প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি চাই’

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঝিনাইদহ
প্রকাশিত: ০৫:০২ পিএম, ১২ মে ২০২২
প্রশিক্ষক হিসেবে সরকারি চাকরি চান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শাহীন আলম। ছবি-জাগো নিউজ

অনেক প্রতিবন্ধী আছেন যারা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও কোনো চাকরি পান না। এজন্যই আমি সেই পথের পথিক না হয়ে ভালোমানের একটি সরকারি চাকরির নিশ্চয়তার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। তারই অংশ হিসেবে আমার আমরণ অনশন ও আন্দোলন কর্মসূচি।

বৃহস্পতিবার (১২ মে) জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপকালে এমনটিই বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শাহীন আলম।

শাহীন আলম ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার আজমপুর ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামের আব্দুল কাদেরের ছেলে।

২০১৫ সালে এইচএসসি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হন। ২০১৯ সালে অনার্স শেষ করেন। বর্তমানে তিনি মাস্টার্সের ছাত্র।

লেখাপড়ার পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন শাহীন আলম। নিজ উদ্যোগে ভারত, বাংলাদেশের প্রায় ২০০ শিক্ষার্থীকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শাহীন আলম জন্ম থেকেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছিলেন না। ১০ বছর বয়সে জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারান। পরে পরিবারের সহযোগিতায় সমাজসেবা অধিপ্তরের আর্থিক অনুদান নিয়ে এসএসসি পাস করেন।

সেই সহযোগিতা শেষ হলে এইচএসসি পর্যায়ে ডাচ্‌-বাংলা ব্যাকের বৃত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান তিনি। পরে প্রেমের সম্পর্কের জেরে যশোর জেলার ফুলবাড়ি এলাকায় পরিবারের অমতে বিয়ে করেন। সেই থেকেই নানা কারণে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থার প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন শাহীন আলম।

আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে বর্তমানে তার একটি চাকরি দরকার বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত এই শিক্ষার্থী। তবে তার প্রত্যাশা যোগ্যতা অনুযায়ী একটি সরকারি চাকরি।

সরকারি চাকরির নিশ্চয়তার দাবিতে সোমবার (৯ মে) সকাল ৯টা থেকে ঝিনাইদহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরণ অনশনে বসেছিলেন শাহীন আলম। পরে রাত ৯টার দিকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনশন ভাঙান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সেলিম রেজা।

তবে শাহীন তার বিবাহের কথা না লিখে তা এড়িয়ে যেতে বলেন। বলেন, বিয়ের বিষয় নিউজে আসুক সেটা আমি চাই না।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শাহীন আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনশনে বসার পর জেলা প্রশাসন থেকে চাকরির আশ্বাস দিলে আমি অনশন স্থগিত করি। পরে মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আমাকে ডেকে পাঠালে সেখানে তারা আমাকে বলেন, যতদিন সরকারি চাকরি না হয় ততদিন এখানে ডাটা এন্ট্রির কাজ করতে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রতিটা এন্ট্রিতে ২৫ টাকা করে পাবেন। অথবা একটি বেসরকারি স্কুলে চাকরি করেন। কিন্তু আমার কাছে এটা চাকরি বলে মনে হয়নি। তখন তাদের আমি জানাই, এটা আমার সাথে যায় না। আমি জেলা প্রশাসনের কাছে না, প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাকরি চেয়েছি। তিনিই আমাকে চাকরি দেবেন। যেহেতু কম্পিউটার জানি, তাই প্রশিক্ষক হিসেবেই সরকারি চাকরি চাই। যেখানে জাতীয় বেতন স্কেল অনুসারে আমার বেতন হতে হবে। নাহলে আমি আবারও অনশনে বসবো। কারণ এখন আমি খরচ চালাতে পারছি না।’

‘তখন তারা উচ্চস্বরে আমাকে বলেন, তাহলে এখানে কেন? প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে কিংবা অন্য কোথাও গিয়ে অনশন করেন। এখানে অনশন করতে গেলে অনুমতি নিতে হবে। তখন আমি বলি, আপনারা অনুমতি দেবেন না, তাই আমি নিজেই অনশন শুরু করি। এটা বলেই বেরিয়ে আসি। তবে চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত স্থগিত করা অনশন কর্মসূচি চালিয়ে যাবো।’

শাহীন আলমের স্ত্রী শারমিনের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে তার বাড়ি থেকে। তবে মাঝে মধ্যে তাকেও কিছু খরচ দেন শাহীন আলম। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা, মা বা বড় ভাই আমাকে কোনো আর্থিক সহযোগিতা দেয় না।’

‘সরকারি চাকরির বয়স এখনও পাঁচ বছর আছে। তবে পরে অন্যান্য প্রতিবন্ধীর মতো যদি আমিও পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না পাই তাহলে আমার অবস্থাও তাদের মতো হবে। এরই মধ্যে আমি এইচএসসি পাসের যোগ্যতায় সাতটি পরীক্ষা দিয়েছি। তবে আমাকে চাকরি দেওয়া হয়নি। তাই আগে থেকেই চাকরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, আন্দোলন করছি’ যোগ করেন সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী শাহীন আলম।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী শাহীন আলমের বাবা আব্দুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, ‘দুই ছেলেকে নিয়ে আমার চারজনের সংসার ছিল। বড় ছেলে আর আমি মিলে শাহীনের এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়ার খরচ চালাই। এইচএসসি পাস করার পর সে বিয়ে করে। এরপর নানা কারণে তার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। বর্তমানে সে নিজের মতো করে চলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘শাহীন চাকরির জন্য অনশন করছে সেটা আমি জানি না। মাত্রই আপনার কাছ থেকে শুনলাম। তার আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ। তার বিষয়ে আমি আর বেশি কিছু বলতে চাই না।’

এ বিষয়ে ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনশন যে কেউ করতেই পারে। এটা সাধারণ ব্যাপার। শাহীনের অনশনের পর আমরা তাকে চাকরির জন্য অফার করেছিলাম। কিন্তু সেটা সে নিতে চায় না। এখন সে যদি প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয় তাহলে সেটা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আমরা করতে পারি।’

আব্দুল্লাহ আল মাসুদ/এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।