পুরুষের সঙ্গে দিচ্ছেন পাল্লা
মোটরসাইকেল মেকানিক হয়ে সংসারের হাল ধরেছেন নারীরা
![মোটরসাইকেল মেকানিক হয়ে সংসারের হাল ধরেছেন নারীরা](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019November/pic-1-20220728212705.jpg)
বাবার মৃত্যুর পর ছয় ভাই-বোনের সংসারে সুফিয়া ছিল যেন বাড়তি বোঝা। কেননা বিয়ের এক বছরের মধ্যে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তাই নিজের ভাই বোনরাও পর হয়ে যায়। কিন্তু হার মানেনি সুফিয়া। অনেকের কটূক্তি আর বাধা অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার পথ খুঁজে বের করেছেন।
প্রশিক্ষিত হয়ে মোটরসাইকেল মেকানিকের কাজ করে হাল ধরেছেন সংসারের। সুফিয়ার মতোই আমিনা, মরিয়ম, ঝিনুক, আলতাফুন এখন স্বাবলম্বী। তাদের কেউ সার্ভিসিং সেন্টার দিয়েছেন। আবার কেউ চাকরি করছেন বড় বড় প্রতিষ্ঠানে। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তারা।
নারীদের মেকানিকের কাজ করা দেখে আগে যারা সন্দেহ করছিলেন তারাই এখন পুরুষ মেকানিকের চেয়ে বেশি আস্থা পাচ্ছেন নারী মেকানিকের কাছে। সারিয়াকান্দি উপজেলা সদরের মোটরসাইকেলচালক হানিফ ও আবুল মুন্সির মতো বেশ কয়েকজন বলেন, নারীরা খুব সাবধানে মেরামত কাজ করেন। এদের কাজ করতে দিলে বাড়তি টেনশন করতে হয় না বললেই চলে।
ভাঙনকবলিত যমুনা তীর ও চরগ্রামের নারীরা এখন মোটরসাইকেল মেকানিক, ইলেকট্রিক মেকানিকসহ সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলা সদর থেকে। সারিয়াকান্দির মা ফাতেমা (রা.) নারী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সরকারিভাবে এ প্রশিক্ষণ দিয়ে নারীদের স্বাবলম্বী করা হচ্ছে।
এরই মধ্যে অনেক নারী চাকরিও পেয়েছেন। অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ওয়ার্কশপ তৈরি এবং সিএনজি অটোরিকশা কিনে চালাচ্ছেন। বগুড়া ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলার সুবিধাবঞ্চিত নারীরা এই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গেই।
স্বাচ্ছন্দ্যে থ্রি হুইলার চালাচ্ছেন নারীরা-ছবি জাগো নিউজ
২০০০ সালের ১ জানুয়ারি সারিয়াকান্দিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে মা ফাতেমা মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ২০০৬ সালে কেন্দ্রটি রাজস্ব খাতের অন্তর্ভুক্তি লাভ করে। ২০১৪ সালের ১১ জুলাই সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান গ্রামীণ অবহেলিত নারীদের জন্য সারিয়াকান্দি মা ফাতেমা (রা) মহিলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে উদ্বোধন করেন সিএনজিচালিত থ্রি হুইলার ড্রাইভিং এবং মোটরসাইকেল মেকানিক্স প্রশিক্ষণ কোর্স। তখন থেকেই কেন্দ্রটিতে গ্রামীণ দরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্ত, বাল্যবিয়ের শিকার নারীদের বিভিন্ন দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করে ইউসেফ।
এ পর্যন্ত এই কেন্দ্রের কয়েকশ প্রশিক্ষিত নারী দেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করছেন। অনেকই নিজেদের উদ্যোগে কর্মস্থানের ব্যবস্থা করছেন।
কথা হয় সোনাতলার জোরগোছার জাহিদা সুলতানা, সারিয়াকান্দির সীমা আক্তার ও শিবগঞ্জের সুফিয়া সুলতানার সঙ্গে। তারা যে কোনো মোটরসাইকেল মেকানিকের কাজ করেন। মোটরসাইকেলও চালাতে পারেন সড়ক ও মহাসড়কে। একই সঙ্গে যান্ত্রিক যে কোনো ত্রুটির কারণে মোটরসাইকেল বিকল হলে যে কোনো স্থানেই সেটি মেরামত করতে পারেন।
সারিয়াকান্দি এলাকার কয়েকজন মোটরসাইকেলচালক বলেন, পুরুষ মেকানিকের চেয়ে নারী মেকানিকরা যত্নসহ তাদের বাইক মেরামত করেন এবং সময়ও কম নেন। এ কারণে তারা নারীদের কাছে বেশি যান।
ইলেক্ট্রিক্যাল কাজ শিখছেন নারীরা-ছবি জাগো নিউজ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালে ১১৯ জন নারী সফলভাবে প্রশিক্ষণ শেষ করে চাকরি পেয়েছেন ৫৩ জন। ২০১৫ সালে ১৮২ জন নারী প্রশিক্ষণ শেষ করে চাকরি পেয়েছেন ১৩২ জন। ২০১৬ সালে ১৯২ জন নারী প্রশিক্ষণ শেষ করে চাকরি পেয়েছেন ১৪৪ জন। ২০১৮ সালে ১৩৮ জন নারী প্রশিক্ষণ শেষ করে চাকরি পেয়েছেন ১১০ জন। ২০১৯ সালে ২৭৯ জন নারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে ২১০ জন চাকরি পেয়েছেন। ২০২০ সালে ১৪৭ জন নারী প্রশিক্ষণ শেষ করে চাকরি পেয়েছেন ১২১ জন।
অনেক অসহায় নারী এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে স্বনির্ভর হয়েছেন। এ পর্যন্ত কেন্দ্রটি থেকে ১ হাজার ৫০০ জন নারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। ২০১৯ সালে যারা প্রশিক্ষণ নেন তাদের মধ্যে মোটরসাইকেল সার্ভিস মেকানিক ৯২ জন প্রশিক্ষণ শেষ করেন।
এদের মধ্যে চাকরি করছেন ৮২ জন। কনজিউমার ইলেকট্রনিক্সে ৯৫ জন প্রশিক্ষণ শেষে চাকরি পেয়েছেন ৬১ জন। ইলেক্ট্রিশিয়ান কোর্সে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন ৯২ জন চাকরি পেয়েছেন ৬৭ জন। চাকরিরত নারীরা প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এবং ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে কর্মরত। তিন মাসের প্রশিক্ষণকালীন থাকা খাওয়া ফ্রিসহ ৯০০ টাকা প্রশিক্ষণকালীন ভাতা পান প্রশিক্ষণার্থীরা। কেন্দ্রটির একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ ১৩ জন কর্মরত রয়েছেন।
পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রস্তুত তারা-ছবি জাগো নিউজ
এর আগে ২১ মার্চ ২০২০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম করোনার কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে স্বল্প পরিসরে পুনরায় ইউসেফের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মোটরসাইকেল মেকানিক, কনজিউমার ইলেক্ট্রনিক্স এবং ইলেক্ট্রিশিয়ান তিনটি ট্রেডে বর্তমানে এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ নিচ্ছেন ৫০ জন গ্রামীণ অবহেলিত নারী। এদের মধ্যে মোটরসাইকেল মেকানিকে ১০ জন, কনজিউমার ইলেকট্রনিক্সে ২০ জন এবং ইলেক্ট্রিশিয়ানে রয়েছেন ২০ জন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী কনজিউমার ইলেক্ট্রনিক্সের প্রশিক্ষণার্থী নমিতা মার্টি বলেন, বাবা মা এবং সমাজের বোঝা হয়ে না থেকে এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আত্মনির্ভরশীল হতে এসেছি। আমি চাকরি করে আমার পরিবারের দুঃখ ঘোচাব।
নারীরা প্রশিক্ষণেও বেশ মনোযোগী বলছেন প্রশিক্ষকরা-ছবি জাগো নিউজ
সারিয়াকান্দির চন্দনবাইশা এলাকার মরিয়ম খাতুন বলেন, আমি বেশ আগে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। অটোরিকশা চালানোর কৌশল, ট্রাফিকিং, ছোট ছোট কিছু সমস্যার বিষয়েও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এখন অটোরিকশা চালিয়ে নিজের সংসারের হাল ধরতে পারছি।
প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ইন্সস্ট্রাক্টররা বলেন, নারীকে কর্মক্ষম করে তুলতে বিভিন্ন ট্রেডের সঙ্গে সিএনজিচালিত থ্রি হুইলার মোটর ড্রাইভিং এবং মোটরসাইকেল সার্ভিস মেকানিক্স ট্রেড কোর্স চালু করা হয়। মেয়েরা যখন মোটর মেকানিক অথবা অটোরিকশা হাতে নেন তখন তাদের মধ্যে অন্যরকম একাগ্রতা ও ইচ্ছাশক্তি থাকে। এই শক্তিই তাদের কাঙ্ক্ষিত পথে নিয়ে যায়।
আগে যারা দ্বিধায় ছিলেন তারাও এখন নারীদের কাছেই যাচ্ছেন মোটরসাইকেল মেরামতের জন্য- ছবি জাগো নিউজ
প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ইন্সস্ট্রাক্টর শামসুল তাব্রেজ বলেন, প্রশিক্ষণের সঙ্গে আবাসিক ব্যবস্থাও করা হয়। হাতে-কলমে শিক্ষা দিতে যাতে গাফিলতি না হয় সেজন্য এ ব্যবস্থা। এ পর্যন্ত যারা প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়েছে তারা প্রত্যেকেই নিজেদের এলাকায় ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বলে জানান তিনি।
সারিয়াকান্দি উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা লায়লা পারভিন নাহার বলেন, সারাদেশ থেকে আসা গ্রামীণ অবহেলিত নারীরা এখানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে চাকরি করে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন। আসন সংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে আমরা বেশি নারীদের প্রশিক্ষণ দিতে পারছি না। যেহেতু আমাদের বিশালাকার আবাসিক বাসস্থান ব্যবস্থা রয়েছে, তাই বেশি সংখ্যক নারীকে প্রশিক্ষণ দিতে সব মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
এসএইচএস/জেআইএম