এক টাকার মাস্টার, শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন ৫০ বছর ধরে

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি গাইবান্ধা
প্রকাশিত: ১২:২৪ পিএম, ১০ নভেম্বর ২০২২

দেশ স্বাধীনের পরের বছর ১৯৭২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন মো. লুৎফর রহমান (৭২)। দারিদ্রতার কষাঘাতে বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। তবে নিজে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে না পারার আক্ষেপ থেকে শিশুদের ঝরেপড়া রোধে বিনা পয়সায় পড়ানো শুরু করেন তিনি। পরে অভিভাবকদের অনুরোধে দিনে এক টাকা পারিশ্রমিক নেওয়া শুরু করেন। আর এভাবেই প্রায় ৫০ বছর ধরে চলছে তার শিক্ষকতা জীবন। এখন এলাকায় ‘এক টাকার মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত এই বিদ্যানুরাগী।

উত্তরের জনপদ গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা লুৎফর রহমান। সেখানকার স্থানীয় বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ধারে টিনের ঘরে পরিবার নিয়ে তিনি বসবাস করেন।

জানা গেছে, অভাব-অনটন আর দারিদ্রতার মাঝে ১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুণভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন লুৎফর রহমান। এরপর অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় পড়াশোনা। নিজের সেই আক্ষেপ লুকিয়ে শিক্ষার্থী ঝড়েপড়া রোধ ও শিক্ষার আলো ছড়ানোর ব্রত নেন তিনি। এ কারণে কোথায়ও চাকরি না করে ১৯৭২ সাল থেকে সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বিনামূল্যে পড়ানো শুরু করেন তিনি।

পরে স্থানীয় অভিভাবকদের অনুরোধে প্রতিদিন এক টাকা করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নিয়ে পড়ানো চালিয়ে যান লুৎফর রহমান। এভাবেই পাঁচ দশক ধরে শিক্ষকতা করে চলেছেন তিনি। এ কারণে স্থানীয়দের কাছে এক টাকার মাস্টার হিসেবে পরিচিতি পান তিনি।

স্বজনরা জানান, একসময় ৮০ বিঘা জমি, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু সবই ছিল লুৎফর রহমান পরিবারের। কিন্তু ১৯৭৪ সালের বন্যা ও নদী ভাঙনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হন তারা। পরে আশ্রয় নেন বাগুড়িয়া গ্রামের ওয়াপদা বাঁধে। স্ত্রী লতিফুল বেগমসহ দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার তার। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে। বড় ছেলে লাভলু এসএসসি পাস করার পর অর্থাভাবে আর পড়তে পারেননি। এখন অটোরিকশা চালান। ছোট ছেলে মশিউর রহমান একটি মাদরাসা থেকে দাওরা (মাস্টার্স সমমান) পাস করে বেকার।

জলিল উদ্দিন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জাগো নিউজকে জানান, ফজরের নামাজ পড়ে বাড়ি থেকে বের হন লুৎফর রহমান। এরপর পায়ে হেঁটে, কখনো বাইসাইকেল চালিয়ে পথ পাড়ি দেন তিনি। পাশের বাগুড়িয়া, মদনেরপাড়া, পুলবন্দি, চন্দিয়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্চিপাড়া, মধ্যপাড়া ও পূর্বপাড়াসহ কয়েকটি গ্রামের শিক্ষার্থী পড়ান তিনি।

মো. খাজা মিয়া নামে আরেক প্রবীণ ব্যক্তি জাগো নিউজকে বলেন, লুৎফর রহমানের লক্ষ্য প্রাথমিকে ঝরেপড়াসহ ভাঙনকবলিত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাদান। অভিভাবকদের বুঝিয়ে শিশুদের নিয়ে কখনো রাস্তার ধারে, বাঁধে কিংবা গাছতলায় পড়াতে বসে পড়েন। বর্তমানে তার ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ জন। প্রতি ব্যাচে ১০ করে পাঠদান করেন।

চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জেসমিন খাতুন জাগো নিউজকে বলে, লুৎফর স্যার আমাদের অনেক আদর করে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ায়। তার কাছে পড়তে আমাদের অনেক ভালো লাগে। স্যার খুব ভালো মানুষ।

লুৎফর রহমানের স্ত্রী লতিফুন বেগম জাগো নিউজকে বলেন, পড়ালেখা শেখানোই তার নেশা। কখনো হেঁটে আবার কখনো সাইকেলে চড়ে ঘুরে ঘুরে শিশুদের পড়ালেখা করাচ্ছেন।

এক টাকার মাস্টারখ্যাত লুৎফর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, যমুনা নদীবেষ্টিত ওয়াপদা বাঁধের চারপাশের গ্রামগুলো বন্যাকবলিত। বেশির ভাগ মানুষ গরিব। সন্তানদের পড়াতে অনীহা দেখান অভিভাবকরা। সেজন্য নামমাত্র গুরুদক্ষিণা নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা শেখাই।

তিনি বলেন, ম্যাট্রিক পাস করার পর অর্থাভাবে কলেজের বারান্দায় পা রাখতে পারিনি। এই না পাওয়ার বেদনা ভুলতেই আমি শিক্ষার্থীদের পড়াই। এটা আমার নেশায় পরিণত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, যখন পড়ানো শুরু করি তখন মানুষের ঘরে ঘরে অভাব। প্রথমে বিনাপয়সায় পড়িয়েছি। পরে এক টাকা করে নেওয়া শুরু করেছি। এখনো যে যা দেয় তাই নিই। আমার ছাত্র অনেকেই ভালো ভালো জায়গায় গেছে। সরকারি ডাক্তার, প্রভাষক, কলেজের প্রিন্সিপালও হয়েছে। এসব মনে হলে, সব কষ্ট ভুলে যাই।

স্থানীয় সমাজকর্মী ও লুৎফর রহমানের সাবেক ছাত্র মো. বদিয়াজ্জামান মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, বিখ্যাত কিছু দার্শনিকের নাম জানি যারা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে মানুষদের সমবেত করে জ্ঞান দান করতেন। লুৎফর স্যারের পাঠদান পদ্ধতিটাও ঠিক এরকম। স্যারের জন্য সব সময় দোয়া করি।

গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ ইদু জাগো নিউজকে বলেন, লুৎফর মাস্টার একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। মাত্র এক টাকার বিনিময়ে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার মতো ভালো মানুষ আরও দরকার, তাহলে আমাদের সবার উন্নয়ন হবে।

এমআরআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।