শুঁটকি পল্লি

দুবলার চরে জেলেদের দুর্বিষহ জীবন

আহসানুর রহমান রাজিব
আহসানুর রহমান রাজিব আহসানুর রহমান রাজিব , সাতক্ষীরা
প্রকাশিত: ০৩:৫৮ পিএম, ০৮ ডিসেম্বর ২০২২

অডিও শুনুন

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রামের মালো পাড়ার বাসিন্দা উজ্জ্বল বিশ্বাস। প্রতিবছরের মতো এবারও অন্য জেলেদের সঙ্গে বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ শিকার করতে এসেছেন সুন্দরবনের দুবলার চরে। জাল দিয়ে মাছ ধরার সময় হঠাৎ পায়ে মাছের কাঁটা ফুটে আহত হয়েছিলেন তিনি। চিকিৎসা নিয়েছেন চরের হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে।

ক্ষতস্থানে কোনোরকম ব্যান্ডেজ করে আবার ছুটে যান সাগরে। তবে একমাসেও তার সেই ক্ষত ভালো হয়নি। তাই চর ছেড়ে এবার বাড়িতে ফিরে যাবেন। কারণ খুলনায় গিয়ে ভালো একজন চিকিৎসককে দেখাবেন তিনি।

jagonews24

উজ্জ্বল বিশ্বাসের মতো সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন উপকূলীয় জেলা থেকে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ দুবলার চরে অবস্থান করছেন মাছ শিকার, শুঁটকি তৈরি, পরিবহন ও বেচাকেনার কাজে। তবে বিপুলসংখ্যক এই মানুষদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য চরে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা সরকারি চিকিৎসক নেই।

বনবিভাগের তথ্যমতে, পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের অধীনে আলোর কোল, অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা, শ্যালার চর, মেহের আলীর চর, নারকেলবাড়িয়া চরসহ সুন্দরবন তীরের কয়েকটি চরে পাঁচ মাস ধরে চলে এই শুঁটকি কারবার। সাধারণত প্রতিবছর অক্টোবর মাসের শেষে বনবিভাগ থেকে পাস (অনুমতিপত্র) নিয়ে চরে অস্থায়ী আবাস গড়েন জেলেরা।

jagonews24

সেখান থেকে মাছ শিকারের জন্য গভীর সাগরে যান। সকালে ধরা পড়া মাছ নিয়ে চরে ফেরার পর শুঁটকি শুকানোর পল্লিতে চলে শুঁটকি উৎপাদনের প্রস্তুতি। এটি চলে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। ভালোমানের শুঁটকি উৎপাদন হয় এসব চরে। তবে সুপেয় পানির সংকট, রিভার অ্যাম্বুলেন্সসহ প্রাথমিক কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় চরে অবস্থানরত ৩০ হাজার জেলে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।

শুধু তাই নয়, দুর্যোগকালীন এখানকার জেলেদের জন্য নেই আশ্রয়ের কোনো ব্যবস্থা। ফলে প্রতি বছরই এখানে বাড়ছে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংখ্যা। চলতি মৌসুমের শুরুতে দুই জেলেকে সাপে কামড়ায়। এদের মধ্যে সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে মনিরুল গাজী (২৭) নামের এক জেলের মৃত্যু হয়েছে।

jagonews24

দুবলার চরের আলোরকোলে অবস্থানরত জেলে প্রদীপ বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন এখানকার চরগুলোতে জেলেরা দীর্ঘ পাঁচ মাস অবস্থান করেন। তবে এখানে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। আমরা ছোট ছোট কুয়া খনন করে সেখান থেকে পানি পান করি। জেলেরা নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।’

তিনি বলেন, ‘স্থানীয় হাতুড়ে চিকিৎসকরা দোকান বসিয়ে নামমাত্র চিকিৎসা দেন। কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে ট্রলারে করে তাকে মোংলায় নিতে হয়। এতে দীর্ঘ সময় লাগে। পথেই রোগীর মৃত্যু হয়ে যায়।’

jagonews24

দুবলার চরের জেলে দেবব্রত মন্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘জীবন বাজি রেখে সাগর থেকে মাছ শিকার করেন এখানকার জেলেরা। সেই মাছ দুবলার চরে এনে শুঁটকি করা হয়। এখান থেকে বনবিভাগ কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে। অথচ এখানকার জেলেদের জন্য কোনো সুব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে সুপেয় পানির চরম সংকট।’

একই ধরনের সমস্যার কথা বলেন আলোরকোল শুঁটকি পল্লির ব্যবসায়ী দিপঙ্কর কুমার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, চরে সুপেয় খাবার পানি নেই। কুয়া খনন করে যে পানি পাওয়া যায় তা দিয়ে সবার চাহিদা পূরণ হয় না। চরে বনবিভাগ থেকে পুকুর খনন করে দেওয়া হয়েছে তবে সেই পানি লবণাক্ত। ঝড়ের সময় জেলেদের উদ্ধারে কোনো ব্যবস্থা নেই। সাইক্লোন শেল্টার নেই। যা আছে সেটিতে এত মানুষের আশ্রয় হয় না।

jagonews24

তিনি আরও বলেন, ‘গ্রাম থেকে কিছু হাতুড়ে চিকিৎসক এখানে দোকান তৈরি করে চিকিৎসা দিচ্ছেন। তাদের কাছে ভুল চিকিৎসা নিয়ে অনেকে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। আমরা সরকারের কাছে পাঁচ মাসের জন্য ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চালুর দাবি জানাই।’

বনবিভাগ সূত্র জানায়, চলতি বছর ১৫ জন বহদ্দারের (দলনেতা) আওতায় প্রায় ১০ হাজার জেলেকে মাছ শিকার ও শুঁটকি তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। চারটি চরে মোট এক হাজার ৩০টি জেলে ঘর, ৬৩টি ডিপো ও ৯৬টি দোকানঘর নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গতবছর এখান থেকে চার কোটি ১৮ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়। চলতি বছর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে চার কোটি ৫০ লাখ টাকা।

জানতে চাইলে সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় দুবলার চরে দুটি পুকুর খনন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সুপেয় পানি সরবারহের বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। জেলেদের চিকিৎসার জন্য বনবিভাগের পক্ষ থেকে একটি ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী বছর থেকে সেটি চালু করা হবে।

এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।