‘গরিবের ডাক্তার’ খুরশিদ আলম

আব্দুল্লাহ আল-মামুন
আব্দুল্লাহ আল-মামুন আব্দুল্লাহ আল-মামুন , জেলা প্রতিনিধি, ফেনী ফেনী
প্রকাশিত: ০৭:০২ পিএম, ১৫ জানুয়ারি ২০২৩

গ্রামের ভেতর আধাপাকা একটি চিকিৎসাকেন্দ্র। সামনে জড়ো হয়েছেন ৩০ জনের মতো রোগী। একটি কক্ষে এক এক করে রোগী দেখছেন চিকিৎসক। তার কক্ষ থেকে ব্যবস্থাপত্র নিয়ে বের হওয়ার সময় কারও হাতে নেবুলাইজার, কারও হাতে জরুরি কিছু ওষুধ তুলে দিচ্ছেন চিকিৎসা কেন্দ্রের কর্মচারীরা।

নেবুলাইজারের মতো চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে একেবারেই বিনামূল্যে। রোগী দেখার বিপরীতে কোনো ফিও নিচ্ছেন না চিকিৎসক।

এ চিত্র ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের রশিদ-আনোয়ারা মেমোরিয়াল দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রের। প্রায় এক বছর ধরে এভাবেই প্রতি সপ্তাহে বিনামূল্যে রোগী দেখা, জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ চলছে চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে। এটি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করছেন ডা. খুরশিদ আলম।

jagonews24

রশিদ-আনোয়ারা মেমোরিয়াল দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রতি মঙ্গলবার বিনামূল্যে রোগী দেখার পাশাপাশি দেওয়া হয় জরুরি ওষুধ। গত ১১ মাসে সেখানে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ১২০০ রোগী।

আরও পড়ুন: ২ টাকায় শীতের পিঠা, যত খুশি তত খাও

সম্প্রতি রোগী দেখার ফাঁকেই কথা হয় চিকিৎসক খুরশিদ আলমের সঙ্গে। তিনি জানান, তার জন্ম গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারে। তখন পল্লিচিকিৎসকদের ওপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল গ্রামের মানুষ। তার মা অসুস্থতার সময় যথাযথ চিকিৎসা পাননি। তাই তার বাবা ও মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলে চিকিৎসক হয়ে গ্রামের মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেবে। সেই স্বপ্ন থেকেই ময়মনসিংহের কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগকে কাজে লাগান খুরশিদ আলম। সেখান থেকে এমবিবিএস শেষ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে অ্যানেস্থেসিয়া বিষয়ে কোর্স সম্পন্ন করেন।

২০১১ সালে যোগ দেন সরকারি চাকরিতে। তবে চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই তার বাবা-মায়ের মৃত্যু হয়। অসুস্থ বাবা-মাকে যথাযথ চিকিৎসা নিতে না পারার আক্ষেপ থেকে গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র করার উদ্যোগ নেন তিনি।

নিজেদের ২১ শতক জমির ওপর গড়ে তোলেন বাবা আবদুর রশিদ ও মা আনোয়ারা বেগমের নামে চিকিৎসা কেন্দ্রটি। ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে রোগী দেখা।

jagonews24

আরও পড়ুন: ২২ হাজার শিক্ষার্থীর গ্রন্থাগারে আসন ১৬!

খুরশিদ আলম জাগো নিউজকে জানান, প্রতি মঙ্গলবার বিকেল ৪টা থেকে ৪০-৫০ জন রোগী দেখেন। গরিব ও অসহায় রোগীদের কিছু জরুরি ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। গরিব শ্বাসকষ্টের রোগীদের বিনামূল্যে নেবুলাইজারও দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে রয়েছে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় ও ব্লাড সুগার পরীক্ষার সুযোগ। প্রতি বছর একাধিকবার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে মেডিকেল ক্যাম্পও করা হয় চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে।

খুরশিদ আলম বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে এ পর্যন্ত প্রায় ১১ মাসে ১২ রোগীকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে। জটিল রোগী হলে প্রাথমিক সেবা দেওয়ার পর ফেনী জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

চিকিৎসক খুরশিদ আলম বর্তমানে ফেনী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে কর্মরত। কর্মস্থল তার বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে হওয়ায় চিকিৎসা কেন্দ্রে সময় দেওয়া তার জন্য সহজ হয়েছে। পাশাপাশি ফেনী শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী দেখেন।

jagonews24

আরও পড়ুন: নারিকেলের জন্য পরিচিত ফেনীর ‘সিলোনিয়া বাজার’

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, রশিদ-আনোয়ারা মেমোরিয়াল দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রটি অবস্থিত ফেনী শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে। চিকিৎসক খুরশিদ আলমের বাড়ির পাশে এটি গড়ে তোলা হয়েছে। চিকিৎসক উপস্থিত হওয়ার আগেই চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনে নানা বয়সী রোগীদের ভিড়। চিকিৎসা কেন্দ্রের একজন কর্মচারী রোগীদের নাম রেজিস্টারে লিখে প্রত্যেককে সিরিয়াল নম্বর দিচ্ছেন।

এরই মধ্যে বিকেল ৪টার আগেই চিকিৎসক এসে হাজির। রোগী দেখা শুরু করেন তিনি। চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে স্বাস্থ্যসেবা দিতে খুরশিদ আলমের সঙ্গে এক নারী কর্মীসহ দুজন কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন।

চিকিৎসকের কক্ষ থেকে বের হওয়ার সময় চিকিৎসা কেন্দ্রের সামনেই কথা হয় স্থানীয় কাশিমপুর গ্রামের বাসিন্দা বৃদ্ধ রুপধন বিবির (৮০) সঙ্গে। তিনি জানান, সারা শরীরে ব্যথাসহ বার্ধক্যজনিত নানা রোগের চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। চিকিৎসক তাকে ব্যবস্থাপত্রের পাশাপাশি কিছু প্রয়োজনীয় ওষুধ বিনামূল্যে দিয়েছেন। এর আগেও অনেকবার চিকিৎসা কেন্দ্রটিতে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।

jagonews24

আরও পড়ুন: কলেজের এক বাসেই ২৭ বছর পার

নুর নাহার (৩৫) নামের স্থানীয় একজন নারী বলেন, ‘টাকা দিয়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। তাই বেশিরভাগ সময় এ চিকিৎসা কেন্দ্রেই চিকিৎসা নেই। খুবই আন্তরিকতা নিয়ে চিকিৎসক রোগী দেখেন।’

স্থানীয় বাসিন্দা শাহজালাল ভূঞা বলেন, চিকিৎসা কেন্দ্রটি করার পর থেকে নিজ গ্রাম ছাড়াও আশপাশের গরিব ও অসহায় রোগীরা বেশ ভালো স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। সপ্তাহে একদিনের পরিবর্তে সময় বাড়ানো গেলে গরিব রোগীরা আরও উপকৃত হতেন।

সমাজসেবক আবু তাহের বলেন, ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে খুরশিদ আলমের নাম ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি ফি নেন না, জরুরি ওষুধও দেন। তার মতো অন্য চিকিৎসকরা এগিয়ে এলে গরিব ও অসহায় রোগীরা বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবেন।

এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।