গভীর রাতে বাড়ি বাড়ি শীতবস্ত্র পৌঁছে দেন মোস্তফা

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঠাকুরগাঁও
প্রকাশিত: ১২:৫৩ পিএম, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩

রাত ১২টা। চারদিকে সুনসান নীরবতা। তীব্র শীতে ঘুমিয়ে পড়েছে পুরো গ্রাম। এমন সময় হঠাৎ দরজায় কড়া নেড়ে ওঠায় ঘুম ভেঙে যায় আব্দুল জলিলের। দরজা খুলে দেখতে পান শীতের কাপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক যুবক। কাপড় পছন্দ করতে বলেন জলিলকে।

মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে কাপড় বিক্রির বিষয়টিতে বিরক্ত হন আব্দুল জলিল। তবুও এক নজর নেড়েচেড়ে দেখলেন কিছু কাপড়। টাকা না থাকায় কোনো কাপড় লাগবে না বলে জানান ওই যুবককে।

আরও পড়ুন: আরেকটি মানবতার গল্প

মাঝরাতে দরজায় কড়া নেড়ে ডেকে তোলায় আতঙ্কিত ছিলেন জলিলের পরিবার। তবুও সেদিন দরজা খুলেছিলেন ভয় নিয়ে। প্রতি শীতে এভাবেই কড়া নেড়ে ছিন্নমূল মানুষকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন মো. মোস্তফা। তাদের জন্য নিয়ে যান শীতের কাপড়।

সেদিন জলিলের পরিবারের তিন সদস্য পেয়েছিলেন একটি করে শীতের পোশাক। পেয়েছেন একটি কম্বলও। বেশকিছু কাপড় থেকে পছন্দের কাপড়টা বেছে নেবার সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি। জীবনে প্রথমবার এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে বেশ অবাক হন জলিল।

বিষয়টি জানতে পেরে কনকনে শীতে মোস্তফাকে খুঁজতে বের হই। তার দেখা মেলে গ্রামের এক সরু পথে। শীতার্তদের খোঁজে বের হন মাঝ রাতের এ ফেরিওয়ালা।

আরও পড়ুন: ‘মানবতা’ নেই মানবতার দেওয়ালে

স্থানীয়রা জানান, মোস্তফার বাসা ঠাকুরগাঁওয়ের আউলিয়াপুরের কচুবাড়িতে। সারা বছরের জমানো টাকায় শীতে নিজ গ্রামে ঘুরে শীতবস্ত্র পৌঁছে দেন তিনি। নিজে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও মানবতার অন্যান্য নিদর্শন রেখে যাচ্ছেন এ যুবক।

গ্রামের কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে সাত বছর আগে মানবিক এ কাজ শুরু করেন মোস্তফা। তবে আস্তে আস্তে একা হয়ে পড়েন তিনি। কিন্তু সাহস হারাননি মোস্তফা। অন্যরা ছেড়ে গেলে একাই গ্রামের শীতার্তদের দরজায় কড়া নাড়ছেন এ যুবক।

গভীর রাতে বাড়ি বাড়ি শীতবস্ত্র পৌঁছে দেন মোস্তফা

নিজেদের সাড়ে ৩ বিঘা জমির সঙ্গে কিছু জমি বর্গাচাষ করে জীবন-যাপন করেন মোস্তফা। পরিবারের প্রয়োজন মিটিয়ে সারাবছরে টুকে টুকে জমানো টাকা দিয়ে শীত নিবারণের জ্যাকেট ও কম্বল বিতরণ করে যাচ্ছেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোস্তফা জানান, সাত বছর আগে একটি স্কুল মাঠে কম্বল বিতরণ হচ্ছিলো। কম্বল হাতে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ। চোখে পানি দেখে বৃদ্ধকে থামিয়ে কারণ জানতে চাই। তখন তিনি জানান- প্রতিবেশীর কাছে জেনে কম্বল নিতে যাই। সেখানে অনেক মানুষ কম্বল নিতে যান। কিন্তু কম্বল পেতে প্রায় ৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। কম্বল নিতে গিয়ে ওই দিন কাজে যেতে পারেনি তিনি। তাই পরিবারের জন্যে বাজারের টাকাও তার হাতে নেই।

আরও পড়ুন: ভবঘুরে ক্ষুধার্তদের জন্য মানবতার ঝুড়ি

সেদিন বন্ধুরা মিলে তাকে বাজার করে দেই। এরপর তার বাসার সবার জন্যে কিনে দেই শীতের কাপড়। তারপর থেকে বন্ধুরা পরিকল্পনা করে জমানো টাকা দিয়ে গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করি। কিন্তু আস্তে আস্তে সবাই চলে গেছে। এখন একাই চেষ্টা করছি কাজটি করার।

মাঝরাতে শীতবস্ত্র বিতরণের কারণ জানতে চাইলে মোস্তফা বলেন, দিনের সময় শীতবস্ত্র দেওয়া পক্ষে সম্ভব নয়। দিনে দিতে গেলে অনেকে চাইতে আসবে। তাদের দিতে গিয়ে দেখা যাবে প্রকৃতরা পায়নি। আমার সামর্থ্য কম। প্রথমে গ্রামের প্রকৃত অভাবগ্রস্তদের চিহ্নিত করি। পরে রাতের আধারে চুপিচুপি তাদের শীতের কাপড় দিয়ে আসি।

ঠাকুরগাঁও নাগরিক সমাজের সভাপতি আবু মহিউদ্দীন বলেন, তার এমন চিন্তাকে সাধুবাদ জানাই। দেড়শ টাকার কম্বল সংগ্রহ করতে হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। ফলে দিনমজুর শ্রেণির মানুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হন।

তানভীর হাসান তানু/আরএইচ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।