ময়লায় ভরাট পুকুর, অগ্নিকাণ্ডে পানি সংকটের শঙ্কা
কিশোরগঞ্জ শহরের যে কয়টি পুকুর বর্তমানে দৃশ্যমান রয়েছে সেগুলোও আবর্জনা ও ময়লায় ভরাটের পথে। কিছু পুকুর মালিক নিজেরাই ভারাট করে বাসা-মার্কেট তৈরি করেছেন। আবার কিছু পুকুর পৌরসভার আবর্জনা ও ময়লায় ভরাট হচ্ছে। যে পুকুরগুলো এখনো রয়েছে সেগুলোর পানি বেশিরভাগই ব্যবহারের অনুপযোগী। এতে নষ্ট হচ্ছে শহরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। ফায়ার সার্ভিসের শঙ্কা, পুকুরগুলো ভারাটের কারণে শহরে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে দেখা দেবে পানি সংকট।
জানা গেছে, একসময় কিশোরগঞ্জ শহরে প্রায় শতাধিক পুকুর ছিল। এসব পুকুরের পানিতে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটাতেন। কিন্তু আবর্জনা ও ময়লায় ভরাট হয়ে শহর থেকে পুকুরগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে হাতেগোনা যে কয়টি পুকুর দৃশ্যমান রয়েছে, সেগুলোও ভরাটের পায়তারা চলছে। কিছু পুকুর মালিকরা নিজেরাই ভারাট করছেন আবার কিছু পুকুর পৌরসভার আবর্জনা ও ময়লায় ভরাট হচ্ছে।
জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০-এর ৩৬ ধারা অনুযায়ী কোনো পুকুর, জলাশয়, খাল, লেক ভরাট করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও নিষিদ্ধ। তবে সেই জলাধার আইনের তোয়াক্কা না করে পুকুরগুলো ভরাট করে বাসা-মার্কেট নির্মাণ করছে একটি মহল।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার তথ্যমতে পৌর শহরসহ আশপাশের এলাকায় ১৮৮টি পুকুর বা জলাধার ছিল। বর্তমানে কিশোরগঞ্জ শহরে ২৭টি পুকুর কোনোমতে টিকে রয়েছে। এরমধ্যে ব্যবহারের উপযোগী ১৭টি পুকুর। শহরে ৮টি সরকারি পুকুরও রয়েছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শহরের নগুয়া শেষ মোড়ের পুকুরের বেশিরভাগ অংশ ভরাট করে মার্কেট তৈরি করা হয়েছে। হয়বতনগর এলাকার একটি পুকুরের অর্ধেক মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছে। নগুয়া হাসমত উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পূর্ব পাশের পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিমের কোণা ভরাট করে ছোট একটি দোকান তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া পুকুরটিতে ময়লা ফেলায় পুকুরের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
নগুয়া এনজেল স্কুলের বিপরীত দিকের পুকুরের পূর্ব পশ্চিম কোণা ভরাট করে পৌরসভার ময়লার ডাস্টবিন তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও আবর্জনা ও ময়লায় পুকুরের পানি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বিন্নগাঁও এলাকার একটি পুকুরের পানি এখনও মানুষ ব্যবহার করছে কিন্তু আশপাশে পৌরসভার ডাস্টবিন না থাকায় স্থানীয় অনেকেই পুকুরে ময়লা ফেলে পানি নষ্ট করছে।
নগুয়া বালিকা মাদরাসার সামনে ও পেছনের পুকুরটির পানিও মায়লায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। খড়মপট্টি জোড়াপুকুর এলাকার একটি পুকুর ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করছে মালিকপক্ষ। গাইটাল শ্রীনগর রোডের একটি পুকুর ভরাট করে চলছে স্থাপনা নির্মাণের কাজ। তাছাড়া ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করা হচ্ছে বিন্নগাঁও ও সুইপার কলোনি এলাকার পুকুর।
বত্রিশ এলাকায় শহরের সবচেয়ে বড় পুকুর হিসেবে পরিচিত প্রামাণিক বাড়ির পুকুরটিও নানাভাবে দখল ও ভরাটের চেষ্টা চলছে। সাহেববাড়ির পুকুরটিও আর নেই।

বিন্নগাঁও এলাকার একটি পুকুরের মালিক সুশান্ত বসাক জানান, তাদের পুকুরটির পানি এখন আর আগের মতো ভালো নেই। এ পানিতে গোসল করলে শরীর চুলকায়।
তার দাবি আশপাশে পৌরসভার ডাস্টবিন না থাকায় অনেকেই লুকিয়ে পুকুরে ময়লা ফেলে। এতেই পুকুরের পানি নষ্ট হচ্ছে।
হযরত আলী নামের এক বাসিন্দা বলেন, আগে আমাদের এলাকায় অনেক পুকুর ছিল। এখন আর সেই পুকুরগুলো নেই। আমাদের গোসল করা ও কাপড় ধোয়া এই পুকুরের পানিতেই হতো। এখন আর তা হয় না। যে পুকুরগুলো রয়েছে গন্ধে সেগুলোর পানিতে নামা যায় না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জুয়েল বলেন, আমরা পৌর শহরের পুকুর রক্ষায় আন্দোলন করে যাচ্ছি। কয়েকটি পুকুর ভরাট করা হচ্ছিল, তা আমরা ঠেকিয়েছি। মূলত পৌর এলাকার পুকুর বা জলাধার রক্ষার দায়িত্ব পৌর কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের। কিন্তু কী কারণে তারা এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় তা বুঝতে পারছি না। তাদের কারণেই পুকুরগুলো রক্ষা পাচ্ছে না।

এই দুই প্রতিষ্ঠান কার্যকর উদ্যোগ নিলে কেউ পুকুর ভরাটের সাহস পেত না। দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন ছাড়া পুকুর বা জলাধার ভরাটের কোনো সুযোগ নেই। সেটা ব্যক্তি বা রাষ্ট্র মালিকানাধীন পুকুর বা জলাশয় যা-ই হোক না কেন। ২০০০ সালের দিকেও শহরে শতাধিক পুকুর ছিল। এখন হাতেগোনা কয়েকটি পুকুর দেখা যায় বলেও জানান তিনি।
কিশোরগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র কেমিস্ট রুবাইয়াত তাহরীম সৌরভ বলেন, আইন অনুযায়ী কোনো পুকুর বা জলাধার ভরাট করার সুযোগ নেই। কিন্তু শহরের বেশিরভাগ পুকুরই ভরাট হয়ে গেছে। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলো রক্ষার চেষ্টা আমরা করছি। সম্প্রতি রথখলা পুকুরটি মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সংস্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাদেরকে তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছে। না হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে এ কাজগুলো আমরা করছি।
কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের স্টেশন মাস্টার আবুজর গিফারী বলেন, শহরে বড় ধরনের রিজার্ভার নেই। তাই অগ্নিকাণ্ড হলে পুকুরের পানিই ব্যবহার করতে হবে। যেভাবে পুকুর ভরাট হচ্ছে তাতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে পানির সংকটে পড়তে হবে। যে পুকুরগুলো রয়েছে তা সংস্কার করা জরুরি।
কিশোরগঞ্জ পৌর মেয়র মাহমুদ পারভেজ জানান, পৌরসভায় সরকারি পুকুরের সংখ্যা ৮টি। এ পুকুরগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। পুকুরগুলো মানুষের ব্যবহার উপযোগী করার জন্য আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরের কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। আমি মেয়র হওয়ার পর থেকে কোনো পুকুর বা জলাধার ভরাট করা হয়নি। আমরা যদি জানতে পারি কোনো পুকুর ভরাট করা হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পৌর কর্তৃপক্ষ জলাধার সংরক্ষণের জন্য সর্বদাই কাজ করে যাচ্ছে।
এফএ/এমএস