এলাকায় ‘ত্রাস’ ছিলেন চেয়ারম্যান বাবু

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি জামালপুর
প্রকাশিত: ০৯:৫৮ পিএম, ১৯ জুন ২০২৩
সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যায় অভিযুক্ত সদ্য বরখাস্তকৃত চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু

মাহমুদুল আলম বাবু ‘ভয়ঙ্কর’ এক চরিত্রের নাম। সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যার যিনি মাস্টারমাইন্ড। ক্ষমতা এবং দলীয় প্রভাবের ভয়ে এতদিন কেউ মুখ খোলার সাহস না পেলেও এখন ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে তার অপকর্মের ইতিহাস।

অভিযোগ আছে, কথিত এক পুলিশ ভাইয়ের ছত্রছায়ায় এলাকায় গড়ে তোলেন ত্রাসের রাজত্ব। ক্ষমতার অপব্যবহার করে মাদক, চোরাকারবারি, চাঁদাবাজি, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি।

আরও পড়ুন: যেভাবে সাংবাদিক নাদিমকে হত্যা করা হয়

মাহমুদুল আলম বাবু জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদ্য বরখাস্তকৃত চেয়ারম্যান ও সদ্য বহিষ্কৃত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি ওই ইউনিয়নের কামালেরবার্তী এলাকার মৃত সাহেদুল হকের ছেলে।

স্থানীয়রা জানান, একসময় বাবু নিজ গ্রামে মুদির দোকান চালিয়ে কোনোরকমে দিনাতিপাত করতেন। এরপর চাচাতো ভাই ইঞ্জিনিয়ার হারুনের ঠিকাদারি লাইসেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার নির্মাণ করে অর্থ উপার্জন শুরু করলে দিন পাল্টাতে থাকে তার। ১৯৯৪-৯৫ সালের দিকে ছাত্রজীবনে জাতীয় পার্টির রাজনীতি করলেও পরবর্তীতে ভোল পাল্টে নিরপেক্ষতার ভান ধরেন।

আরও পড়ুন: সাংবাদিক নাদিম হত্যায় ৯ আসামি রিমান্ডে

২০০৮ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। ২০১১ সালে ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় না পেলেও ২০১৪ সালে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। এর শুরু হয় তার আধিপত্য ও নানামুখী তৎপরতা।

এদিকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় খুব সহজেই ২০১৬ সালে ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়ে যান তিনি। নির্বাচনের বিজয় তার জীবনে যেন চিরস্থায়ী আশীর্বাদ হয়ে ফিরে আসে। এরপর ২০২১ সালে ফের নৌকার মাঝি হয়ে ফিরে আসেন মাহমুদুল আলম বাবু।

আরও পড়ুন: অভিযুক্ত বাবু চেয়ারম্যানকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার

একদিকে দুবারের নৌকার চেয়ারম্যান, অন্যদিকে দীর্ঘদিন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ। এ দুইয়ে মিলে এলাকায় গড়ে তোলেন ‘ত্রাসের রাজত্ব’। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা থেকে শুরু করে সব জায়গায় ভাগ বসাতে থাকেন তিনি। অবশ্য এরজন্য উপজেলার কিছু নেতার আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন।

ছেলে রিফাতও বাবার পথেই হাঁটতে থাকেন। ক্ষমতার দাপটে হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। শুরু করেন চাঁদাবাজি, ইভটিজিংসহ নানা অপকর্ম। বাবার ক্ষমতার জোরে উপজেলার ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদও পান তিনি। জেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে ছবি তুলে এলাকায় বনে যান বড় মাপের নেতা। গড়ে তোলেন একটি বাহিনী। যাদের কাজ ছিল রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা। এতদিন ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি। তবে সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ডের পর থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে চেয়ারম্যানপুত্রেরও সব অপকর্ম।

রিফাতের বিষয়ে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি খাবীরুল ইসলাম খান জাগো নিউজকে বলেন, সাংবাদিক নাদিম হত্যার ঘটনায় এরই মধ্যে তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।

এমদাদুল হক লালন নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, বাবু চেয়ারম্যানের একাধিক বাহিনী ছিল। যাদের ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেতো না কেউ। এ সুযোগে এলাকায় ধীরে ধীরে তিনি মাদক ব্যবসা, চোরাকারবারি, নারী কেলেঙ্কারি এবং অবৈধ ডলার ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এক সময়ের মুদি দোকানি থেকে হয়ে যান কোটিপতি। তাকে সহযোগিতা করতেন উপজেলার কিছু হেভিওয়েট নেতা। যাদের পথের কাটা ছিলেন সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম। এছাড়া তার এক চাচাতো ভাই পুলিশের একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। তার প্রভাব খাটিয়ে এলাকার সহজ সরল মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করতেন।

আরও পড়ুন: নাদিম হত্যা মামলায় বকশীগঞ্জ থানার ওসির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

লালন আরও বলেন, তার এমন অপকর্ম মুখ বুজে সয়ে গেছেন অনেকে। এছাড়া টাকার বিনিময়ে বাগিয়ে নেন সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। অবশেষে তার পরিকল্পনাতেই জীবন দিতে হলো সাংবাদিক নাদিমকে।

সাধুরপাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, চেয়ারম্যান বাবু একসময় সামান্য মুদিদোকানি ছিলেন। অথচ এক ভাইয়ের ঠিকাদারি লাইসেন্স ও নানা অপকর্মের ফলে এখন কোটিপতি। বর্তমানে ঢাকায় আছে তার বাসাবাড়ি। কামালেরবার্তী এলাকায় মার্কেট, দোকানপাটসহ অনেক সম্পত্তির মালিক তিনি। বর্তমানে এ এলাকায় তার একক আধিপত্য। কোনো জমি পছন্দ হলে তিনি জোরপূর্বক তা টাকা কিংবা পেশীশক্তি দিয়ে ছিনিয়ে নিতেন। তার ভয়ে মুখ খোলার সাহস নেই। টাকা দিলেই কেবল মিলতো বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সব ভাতার কার্ড। এ সব কাজের জন্য তার আলাদা কিছু লোক ছিল। যারা ওই কাজগুলো করতেন।

সাবেক এ চেয়ারম্যান আরও বলেন, পুলিশের সাবেক এক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মোখলেছুর রহমান পান্না তার চাচাতো ভাই। তার সাহসে এলাকায় শক্তি প্রদর্শনের দুঃসাহস দেখাতেন তিনি। মামলা হামলায় ভয় দেখিয়ে নিরীহ মানুষের জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিতেন। এছাড়া একাধিক নারীর সঙ্গে ছিল অবৈধ সম্পর্ক। যা সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায় আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি।

১০ মে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সন্তানের স্বীকৃতি ও স্ত্রীর মর্যাদার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন নামে এক নারী। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এটা সবাই জানে তিনি একজন সামান্য মুদি দোকানি থেকে কোটিপতি। চেয়ারম্যান বাবু নারী লোভী ছিলেন। টাকার লোভ দেখিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক করে তারপর সম্পর্ক অস্বীকার করতেন। ২০১০ সালে আমকে তিনি বিয়ে করেন। ২০১৮ সালে রেজিস্ট্রি করলেও আমাকে তালাক দেন। ২০১৯ সালে আবারও রেজিস্ট্রি কাবিনমূলে দ্বিতীয় দফায় বিয়ে করেন বাবু। সাতমাস আগে আমাদের একটি কন্যাসন্তান হয়। তবে ইউপি চেয়ারম্যান বাবু বিয়ে ও সন্তানকে অস্বীকার করে আসছিলেন।

আরও পড়ুন: সাংবাদিক নাদিমকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতেই চেয়ারম্যানের নির্দেশে হত্যা

সাবিনা ইয়াসমিন আরও বলেন, আমার বিষয় নিয়ে বাংলানিউজসহ একাধিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে ক্ষুব্ধ হন চেয়ারম্যান। এতে আমাকেসহ অনেক সাংবাদিকদের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। বিশেষ করে গোলাম রাব্বানী নাদিম তার চিরশত্রু হয়ে গিয়েছিলেন। শুনেছি তার ছেলে রিফাত ওই ঘটনার পর থেকে তাকে (সাংবাদিক নাদিম) মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে আসছিলেন।

এ সাংবাদিক সম্মেলনের নিউজই কাল হয়ে দাঁড়ায় নাদিমের। এ নিউজের পরই নাদিমকে মেরে ফেলার ছক কষা হয়। যেখানে চেয়ারম্যানসহ নেতৃত্ব দেন উপজেলার আরও কয়েকজন হেভিওয়েট নেতা।

স্থানীয়রা জানান, নিউজ হয় ১০ মে। ১৭ মে ময়মনসিংহ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিক নাদিমসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন মাহমুদুল আলম বাবু। বুধবার মামলাটি খারিজ করে দেন ময়মনসিংহ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল।

পরে ওইদিন রাতে পেশাগত দায়িত্বপালন শেষে বকশীগঞ্জ বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলেন সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম। তিনি পাটহাটি এলাকায় পৌঁছালে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ত্রাসীরা তার ওপর হামলা চালান এবং মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে একটি অন্ধকার গলিতে নিয়ে যান। পরে চেয়ারম্যানপুত্র রিফাত ইট দিয়ে নাদিমের মাথায় সজোরে আঘাত করেন। এ সময় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন চেয়ারম্যান নিজেই।

মারধরে সাংবাদিক নাদিম অচেতন হয়ে পড়লে তাকে ফেলে পালিয়ে যান হামলাকারীরা। পরে স্থানীয়রা তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাত ১২টায় জামালপুর জেনারেল হাসপাতাল এবং সকালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) বিকেল পৌনে ৩টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

সাংবাদিক গোলাম রাব্বানীর তিন সন্তান। রাব্বীলা তুল জান্নাত দ্বিতীয়। বুধবার ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে স্নাতকে ভর্তি হতে বাবার সঙ্গে ময়মনসিংহে গিয়েছিলেন তিনি। জান্নাত জানায়, যেদিন বাবাকে মেরে ফেলা হয় সেদিন বাবার সঙ্গে ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম। বাবা সেদিন তার বিরুদ্ধে যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছিল, সেটার জন্য কোর্টেও গিয়েছিলেন। কিন্তু এ মামলার ভিত্তি না থাকায় মামলটি খারিজও করে দিয়েছিলেন আদালত। খারিজ হওয়ার কাগজও বাবা তোলেন। সেখান থেকে চেয়ারম্যানের ছেলে রিফাতকে ফোনও করেছিলেন। বাবা তাকে (চেয়ারম্যান পুত্রকে) বলেছিলেন, তুমি যে বললা আমার বিরুদ্ধে তোমার বাবা মামলা দেয়নি, এখন তো আমার হাতে কাগজ। কিন্তু মামলা তো খারিজ করে দিয়েছে আদালত। ওই সময় চেয়ারম্যানের ছেলে বাবাকে হুমকি দিয়ে বলছিলেন ‘বকশীগঞ্জে আই তুই, তোরে আজকে মাইরাই ফেলবো’।

বকশীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, আমি ছয় মাস হলো সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছি। বাবুর সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা নেই আমার। তবে যতটুকু জেনেছি তিনি একজন খারাপ প্রকৃতির লোক। আমি সাংবাদিক হত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। একই সঙ্গে দোষীদের বিচার দাবি করি।

বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যা মামলায় চেয়ারম্যানসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চেয়ারম্যানের পাঁচ দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আমারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। এরপর সবকিছুই জানা যাবে। তবে তিনি মাদক ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত কি না তা আমার জানা নেই।

সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু বলে জানিয়েছেন জামালপুরের পুলিশ সুপার নাছির উদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যান বাবুসহ বেশকিছু আসামিকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের ধরতে অভিযান চলমান। এ ঘটনায় আরও অনেকে থাকতে পারেন। যারাই এর সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

মো. নাসিম উদ্দিন/এসজে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।