দখল-দূষণে মৃতপ্রায় ঈশ্বরদীর পাঁচ নদী

শেখ মহসীন
শেখ মহসীন শেখ মহসীন ঈশ্বরদী (পাবনা)
প্রকাশিত: ০৮:০৬ এএম, ২৮ জুলাই ২০২৩

স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে (৫২ বছরে) পাবনার ঈশ্বরদীর ছয় নদীর পাঁচটিই এখন মৃত। বেশিরভাগ নদীর জায়গা বেদখল হয়েছে। তীরবর্তী জমির মালিকরা নিজেদের নামে কাগজ করে দখল করেছে নদী। ফলে সংকুচিত হতে হতে এসব নদী এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।

ঈশ্বরদী উপজেলার উপর দিয়ে বহমান পদ্মা নদীর মতো একসময় কমলা নদী ও সুতা গাং প্রাণবন্ত ছিল। চিকনাই, রতনাই ও চন্দ্রাবর্তী নদীও ছিল পানিতে টুইটুম্বর। কিন্তু এগুলোর সবই এখন মৃতপ্রায়।

জানা যায়, মুলাডুলি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কমলা নদী এক সময় খরস্রোতা ছিল। পদ্মা নদীর সাঁড়া এলাকার ৪নং ঘাট থেকে এ নদীর উৎপত্তিস্থল হলেও কালের বিবর্তনে সেটি এখন আর বোঝার উপায় নেই। দখল-দূষণ আর নাব্যতা হারিয়ে কমলা নদীর অস্তিত্ব এখন সংকটের মুখে। মুলাডুলি ইউনিয়নের ছয়টি গ্রামজুড়ে এ নদীর অস্তিত্ব কিছুটা বুঝা গেলেও তা নালায় পরিণত হয়েছে।

আরও পড়ুন: কুমার নদের নাব্যতা ফেরাতে চলছে পরিচ্ছন্নতার কাজ

সাহাপুর ও আওতাপাড়া এলাকার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত রতনাই নদীর কিছু অংশ এখন খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষাকালে পানি থাকলেও শুঙ্ক মৌসুমে নদীর বুক জুড়ে চলে চাষাবাদ। এক সময় পদ্মা নদী থেকে অরণকোলা-আটঘরিয়া হয়ে চাটমোহর চলনবিলে প্রবাহিত ছিল চিকনাই নদী। এ নদীর অরণকোলা এলাকায় আর কোনো চিহ্ন নেই। তবে চিকনাই নদী আটঘরিয়া ও চাটমোহর উপজেলা দিয়ে এখনো প্রবাহমান।

jagonews24

সুতাগাং সাঁড়া থেকে বাঘইল অচিনতলা হয়ে পাকুড়িয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সুতাগাং বাঘইল এলাকায় মরা গাং নামেও পরিচিত ছিল। দাশুড়িয়ার উত্তর পাশ দিয়ে প্রবাহমান ছিল চন্দ্রাবর্তী নদী। এ নদীর কিছু অংশ এখন সরু নালায় রূপ নিয়েছে। তাছাড়া নদীর বেশিরভাগ জায়গা দখল হয়ে গেছে। অনেকেই বসত বাড়ি নির্মাণ করেছেন। শুকিয়ে যাওয়া নদীতে বছর জুড়েই চলছে চাষাবাদ।

ঈশ্বরদী উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহমান সব নদীর একসময় পদ্মার সঙ্গে সংযোগ ছিল। এছাড়াও অসংখ্য খাল ছিল। এসব খালের বেশিরভাগের এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। পদ্মা নদী থেকে রূপপুর, কামালপুর, দাদাপুর, চরকুড়ুলিয়া হয়ে পাবনা সদর অভিমুখি একটি ক্যানেল দিয়ে বর্ষাকালে পানি প্রবাহিত হয়। এটি স্থানীয়দের কাছে পদ্মার শাখা নদী হিসেবে পরিচিত।

আরও পড়ুন: পাঁচ দশকে হারিয়ে গেছে অর্ধেকের বেশি নদী

সরেজমিনে মুলাডুলি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মৃতপ্রায় কমলা নদীর দু’পাড় দখল হতে হতে এখন সরু নালায় পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকে না। বর্ষাকালে নদী উপচে দু’পাড়ে বসতবাড়ি তলিয়ে যায়। এ নদীর দু’পাড়ে গড়ে ওঠা শত শত পোল্ট্রি খামার ও ছোট ছোট কল-কারখানার দূষিত পানি নদীতে পড়ে পানি বিবর্ণ হয়ে গেছে। কচুরিপনা দিয়ে ভরে গেছে পুরো নদী।

এ নদীর জায়গা দখল করে মুলাডুলির পাঁচ গ্রামে প্রায় অর্ধশতাধিক পুকুর খনন করা হয়েছে। এসব পুকুরের পাশ দিয়ে সরু নালা কেটে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নদীর দু’পাশের জায়গা অনেকেই নিজ নামে কাগজপত্রও করে নিয়েছেন।

মুলাডুলির রামনাথপুর গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কমলা নদীর ঐতিহ্য এখন আর নেই। একসময় এ নদী দিয়ে নৌকা চলাচল করতো। সেই নদী এখন খালে পরিণত হয়েছে। বর্ষাকালে এ নদীর পানি উপচে ফসল নষ্ট হয়। এ অঞ্চলের কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে কমলা নদী খনন অত্যন্ত জরুরি।

jagonews24

 

 

মুলাডুলি গ্রামের জহুরুল ইসলাম বলেন, কমলা নদীর দু’পাশের জমি দখল হতে হতে নদী এখন সরু নালাতে পরিণত হয়েছে। নদীর জায়গা দখল করে বাঁধ দিয়ে অনেকেই পুকুর খনন করেছে। এসব পুকুরে তারা মাছ চাষ করছে। নদীর পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে অবৈধভাবে খনন করা পুকুরের মালিকরা অনেকেই এসব জায়গা নিজেদের বলে দাবি করছেন। নদীর জমি উদ্ধার ও খনন না করলে একসময় পুরো নদীই দখল করে নেবে দখলদাররা। ফলে ঈশ্বরদীর অন্যান্য নদীর মতো একসময় কমলা নদীও হারিয়ে যাবে।

শেখপাড়া গ্রামের গোলাম মোস্তফা বলেন, একসময় নদী ভরা পানি ছিল। সে পানি দিয়ে নদীর দু’পাশের জমিতে ধানের আবাদ করতাম। পাট জাগ দিতাম। নদীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এখন নদী ভরাট হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না। এখন আমাদের একটিই দাবি এ নদী খনন করতে হবে।

আরও পড়ুন: লাবুন্ধা নদী দখল-দূষণমুক্ত করতে ২৪ জনকে লিগ্যাল নোটিশ

রামনাথপুর গ্রামের আবুল হাসেম বলেন, বাপ-দাদার কাছ থেকে শুনেছি একসময় এ নদীতে বড় বড় নৌকা চলতো। জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন নদী ভরাট হয়ে গেছে। আগে বেশ কয়েকবার নদী খননের জন্য মাপামাপি হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি।

মুলাডুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক মালিথা বলেন, বর্ষাকালে মুলাডুলি অঞ্চলের খাল ও নালার সব পানি প্রবাহিত হয় কমলা নদীতে। এ নদী এখন ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষাকালে নদীর পানি উপচে দু’পাড়ের ফসলি জমি ও বাড়ি ঘর তলিয়ে যায়। কমলা নদী খননের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পানাসি প্রকল্পসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় যোগাযোগ করেছি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কারো কোনো সাঁড়া মেলেনি। কমলা নদী খনন করা না হলে এটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

jagonews24

গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক মোশাররফ হোসেন মূসা জাগো নিউজকে বলেন, ব্রিটিশ রেললাইন নির্মাণের সময় কমলা নদীর প্রবাহকে সামনে রেখে ঈশ্বরদী রেলগেটের কাছে বেশ প্রশস্ত একটি সাঁকো নির্মাণ হয়। পাকিস্তান আমলে আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের জন্য জমি হুকুম দখল করা হয়। তখন কৃষি মন্ত্রণালয় কমলা নদীর প্রবাহের জন্য একটি খাল নির্মাণ করে, যা সবুজকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেন থেকে অরনকোলা হাট পর্যন্ত এখনো দৃশ্যমান। ১৯৭৭-১৯৭৮ সালেও দেখা গেছে পশ্চিম টেংরি স্কুল পাড়া থেকে রেলসাঁকোর নিচ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে পানি প্রবাহিত হতো। পৌর মেয়রদের গাফিলতি ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার কারণে কমলা নদীর এ অংশটি প্রাণ হারিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সাঁড়া ইউনিয়ন, ঈশ্বরদী পৌরসভা, মুলাডুলি ইউনিয়নসহ যেসব এলাকা দিয়ে নদীটি প্রবাহিত হয়েছে, সেসব এলাকার জমির মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়। স্থানীয় পর্যায়ে সেসব জমি রক্ষায় এসিল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি পদাধিকারী সরকারি কর্মকর্তারা আছেন। এজন্য দেখা যায়, পাবনাতে কোনো নতুন ডিসি বদলি হয়ে এসেই প্রথমে ঘোষণা দেন- আমার প্রথম দায়িত্ব হলো ইছামতীকে রক্ষা। কিন্তু কোনো ইউএনও ঈশ্বরদীতে যোগদানের পর কি বলেছেন যে, তিনি কমলা নদী উদ্ধার করবেন? বর্তমানে খালটি পাঁচ ফুট প্রশস্ত ড্রেনে পরিণত হয়েছে। অথচ পাঁচ বছর আগেও ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফ ডিলু ভূমিমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর সামান্য টেলিফোনে নদীটির অস্তিত্ব রক্ষার্থে জমি হুকুম দখল করা সম্ভব ছিল। বর্তমানে খালটির উভয় পাশে বহু হাইরাইজ ভবন নির্মাণ হচ্ছে। নদীটির উৎসমুখ বহু আগেই ভরাট করে বাড়িঘর নির্মাণ হয়েছে।

আরও পড়ুন: হালদার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের বিশেষ কর্মসূচি

গবেষক ও লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ঈশ্বরদী উপজেলার ওপর দিয়ে বেশ কয়েকটি ছোট নদী বহমান ছিল। এসব নদীর মধ্যে শুধুমাত্র কমলা নদীর অস্তিত্ব কিছুটা আছে। অন্যসব নদীর জায়গা দখল হয়ে গেছে। একসময়ের এসব নদী এখন বসতবাড়ি ও কৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। নদীর জমি দখলমুক্ত ও নদী খনন করা এখন সময়ের দাবি।

ঈশ্বরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুবীর কুমার দাশ জাগো নিউজকে বলেন, কমলা নদী খননের বিষয়টি এ মুহূর্তে আমার জানা নেই। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জেনে নেবো।

পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, জমি দখল হয়ে নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও নদী খনন বা ড্রেজিং না করার কারণে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে। কোথাও কোথাও আবার নদীর জমি স্থানীয় বাসিন্দারা নিজেদের নামে কাগজপত্র পর্যন্ত করে নেন। নদী দখলমুক্ত করতে কখনো কখনো উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। তবে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ না থাকা ও লোকবলের সংকটের কারণে সবসময় উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব হয় না।

এফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।