৭০০ টাকার পুঁজি থেকে লাবনীর ৩০ লাখের ব্যবসা
কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতা থাকলে সফলতা যে ধরা দেয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত লাবনী আক্তার। সমাজের সকল প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে নিজের হাতে পোশাক ডিজাইন করে সাড়া ফেলেছেন মানিকগঞ্জের মেয়ে লাবনী আক্তার। অনলাইনে তার পোশাকের চাহিদা সারাদেশে। মাত্র ৭০০ টাকা পূঁজির ব্যবসা সাত বছরে দাঁড়িয়েছে ৩০ লাখে। নিজের সফলতার পাশাপাশি তার হাত ধরে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেক নারীর।
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার দিঘী ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন লাবনী আক্তারের বাড়ি। বাড়ির সামনেই তার ছোট্ট পরিপাটি একটি শো-রুম।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, লাবনী তার শো-রুমেই নতুন পোশাক নিয়ে ফেসবুক পেজে লাইভ করছেন। সাবলীল ভাষায় চমৎকারভাবে তার পোশাককে তুলে ধরছেন অনলাইন ক্রেতাদের কাছে।
শো-রুমে থাকা সব পোশাকই লাবনীর নিজের হাতে ডিজাইন করা। তার ডিজাইন করা পোশাকে সুঁই-সুতায় নকশা ফুটিয়ে তোলেন অন্য নারীরা। তার বাড়িতে আরও দুটি ঘর করা হয়েছে গ্রামের নারীরা যাতে সেখানে বসে সুঁই-সুতার কাজ করতে পারেন।
লাবনী আক্তার জানান, মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে অর্থনীতি বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন তিনি। স্বপ্ন ছিল একটি ভালো চাকরি করার। কিন্তু প্রথম সন্তান জন্ম নেওয়ার পর তাকে লালন পালন করতে গিয়ে চাকরির পেছনে ছুটতে পারেননি। সিদ্ধান্ত নেন বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে ঘরে বসে নিজে কিছু করবেন।

ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকির অভ্যাস ছিল লাবনীর। তাই পরিকল্পনা করেন পোশাক ডিজাইন করে অনলাইনে বিক্রি করবেন। এরপর ‘ডিফরেন্ট বিউটি’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলেন। নিজের ডিজাইন করা একটি কুশন কভার মাসখানেক ধরে পোস্ট করার পর তা বিক্রি হয়। প্রথম উপার্জন ছিল ৭০০ টাকা। এটাই তার পূঁজি।
লাবনী জানান, নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিন্তু কখনো হাল ছাড়েননি। ধৈর্য ধরে টিকে থাকার সংগ্রাম করেছেন। স্বামীসহ পরিবারের সদস্যরাও বলেছেন সখ হয়েছে করছে, কদিন পরই ফিরে আসবে। কিন্তু তারপরও ধৈর্য হারাননি। সফলতা দিয়েই সব কথার জবাব দিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, শুরুতে ফেসবুকে শুধু পোশাকের ছবি তুলে পোস্ট করতাম। লাইভ করতে পারতাম না। বার বার চেষ্টার পর শিখেছি।
লাবনী আক্তার বলেন, অনলাইন ব্যবসায় আপনাকে কাস্টমারের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। প্রায়ই দেখা যায়, অনলাইনে কেনাকাটা করে মানুষ ঠকছে। এ কারণেই এই ব্যবসায় টিকে থাকাটা চ্যালেঞ্জের। নারীদের জন্যতো আরও ঝুঁকির।

তিনি বলেন, কাস্টমারের আস্থা অর্জনের জন্য আমি রিটার্ন পলিসি শুরু করি। প্রোডাক্ট ভালো না লাগলে কাস্টমার রিটার্ন করতে পারবেন। এজন্য অনেকেই ভাবলো কিনলেতো টাকা লস হচ্ছে না। তাহলে একবার নিয়ে দেখি। আলহামদুল্লিাহ। এই পলিসি চালু করার পর ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। একটা পোশাকও ফেরত আসেনি। যেহেতু প্রতিযোগিতার মার্কেট, সেজন্য কোয়ালিটি ধরে রাখার চেষ্টা করি।
নতুন নারী উদ্যোক্তাদের উদ্দেশে লাবনী বলেন, উন্নতি করতে হলে অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। আর শুরুতে সাহস দেখাতে হবে। আমি কিছু করবো এভাবে ভেবে লাভ নাই। সাহস করে শুরু করতে হবে। সততার সঙ্গে।
লাবনী আক্তার শাড়ি, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, ওড়না, কুশুন কাভার, কাঁথাসহ বিভিন্ন পোশাকে নকশা একে বিক্রি করেন। বর্তমানে একটি শো-রুম দিলেও অনলাইনেই তার পোশাক বিক্রি হয় বেশি।
সুঁই-সুতার কাজের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় কয়েকজন জানান, লাবনী আপা পোশাকে প্রথমে ডিজাইন করে দেন। এরপর কোন ডিজাইনে কোন রঙের সুতা ব্যবহার করা হবে সেটা বুঝিয়ে দিলে তারা কাজ করেন। এই কাজ করে তাদের বাড়তি আয় হচ্ছে। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগাচ্ছেন। একজন নারী হয়ে লাবনী আক্তারের এই সফলতায় তারা গর্বিত।

লাবনী আক্তার তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ জয়িতা পদক পেয়েছেন। পেয়েছেন বিসিক উদ্যোক্তা পুরস্কার, জেলা প্রশাসকের সম্মাননাসহ নানা পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। সম্প্রতি একটি দাতাসংস্থা থেকে ৭ লাখ টাকা অনুদানও পেয়েছেন তিনি।
মানিকগঞ্জ বিসিক শিল্প নগরীর উপ-ব্যবস্থাপক মো. মাহবুবুল ইসলাম জানান, লাবনী আক্তার সুঁই-সুতার কাজ দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। খুবই ছোট আকারে। পরবর্তীতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিসিকের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যাচে তিনি অংশ নেন। এরপর থেকেই তার ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং সফল হওয়ার জন্য নানা ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছেন তারা। সম্প্রতি ইউএনসিডিএফ থেকে বড় অংকের একটি অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রেও বিসিক তাকে সহযোগিতা করেছে।
মাহবুবুল ইসলাম আরও জানান, লাবনীর মতো যারা উদ্যোক্তা হতে চান, কিংবা কোনো কাজ শুরু করেছেন তাদের পরামর্শ দেবো প্রশিক্ষণ নিয়ে আরও দক্ষ হওয়ার জন্য। কারণ সফল হতে গেলে দক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। বিসিকে উদ্যোক্তাদের জন্য নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানান তিনি।
এফএ/জেআইএম