স্ত্রীর পরকীয়ায় তছনছ মোতালেবের সংসার, চাইলেন অবিচারের প্রতিকার

এন কে বি নয়ন এন কে বি নয়ন ফরিদপুর
প্রকাশিত: ০১:১২ পিএম, ০২ অক্টোবর ২০২৩

ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার চরবিষ্ণুপুর ইউনিয়নের জামতলা বড় বাড়ির সন্তান মোতালেব শেখ (৪৫)। আট বছর আগে তার সঙ্গে বিয়ে হয় পার্শ্ববর্তী কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের শৌলডুবী গ্রামের হাবিবুর রহমানের মেয়ে হাসি বেগমের (২৫)। মুরসালিন নামে সাত বছরের একটি সন্তানও আছে তাদের। চার বছর প্রবাসে থাকার পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে ফিরেন মোতালেব। তিনি ঢাকার বসুন্ধরায় ডেন্টিং মিস্ত্রির কাজ নেন। স্ত্রীর পরকীয়ার কারণে তছনছ হয়ে গেছে তার সংসার।

অভিযোগ আছে, পরকীয়া প্রেমের টানে নিখোঁজ গৃহবধূ হাসি বেগমের কথিত মরদেহ উদ্ধারের পর জীবিত ফিরে এলেও মিথ্যা মামলায় ৭২ ঘণ্টা থানা হাজতে থাকতে হয় তার স্বামী মোতালেব শেখকে। এ ঘটনায় শুরু থেকেই তার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। এমন অভিযোগ মোতালেব শেখের। স্ত্রী নিখোঁজের পর থানায় অভিযোগ দিতে গেলেও আমলে নেওয়া হয়নি।

স্ত্রীর কথিত মরদেহ উদ্ধারের পর তাকে শেষবারের জন্য মুখটিও দেখতে দেওয়া হয়নি। মরদেহ শনাক্তের জন্য ডেকে নিলেও তাকে আটকের পর স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা করেছে বলে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের ভয় দেখানো হয়। এরপর জীবিত অবস্থায় তার স্ত্রী ফিরে এলেও তাকে না জানিয়েই শ্বশুরের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তছনছ হয়ে গেছে তার সংসার। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে উদ্বিগ্ন মোতালেব শেখ ন্যায় বিচার দাবি করেছেন।

আরও বলেন, ‘দাফনের’ পাঁচদিন পর জীবিত ফিরলেন গৃহবধূ 

মোতালেব শেখ বলেন, প্রবাসে থাকাবস্থায় উপার্জনের সব টাকাই স্ত্রীর কাছে দেই। এই টাকা কি করেছে জানি না। বিদেশ থেকে আসার পর কিছুদিন আমার বাড়িতে ছিল। আমি ঢাকা গেলে সে বাবাবাড়ি চলে যেতো। ৭ সেপ্টেম্বর আমি কর্মস্থলে ছিলাম। ওইদিন সকাল ৮টার দিকে স্ত্রী হাসি ফোন করে জানায়, ফুফাতো ভাইয়ের খৎনা অনুষ্ঠানে যাবে। বিদ্যুৎ বিলের কথা বলে আমার কাছ থেকে ৩ হাজার টাকাও নেয়।

মোতালেব শেখের চাচাতো বোন কাকলি আক্তার বলেন, চলে যাওয়ার আগের দিন রাত করে বাড়ি ফিরেন হাসি। তখন জিজ্ঞেস করলে জানান, বাবাবাড়ি থেকে এসেছেন। পরদিন সকালে বিছানাপত্র গোছানোর সময় আমি জিজ্ঞেস করলে জানান, তার ফুপুবাড়িতে অনুষ্ঠান আছে সেখানে যাবেন। ছেলের কথা জানতে চাইলে জানান মামাবাড়ি রেখে এসেছেন।

আরেক চাচাতো বোন মনোয়ারা পারভীন বলেন, হাসি বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার তিন থেকে চারদিন পর বাড়িতে এনজিও থেকে কিস্তির টাকা নিতে আসে। তখন আমরা বলি হাসিকে তো পাওয়া যাচ্ছে না, তার ফোনও বন্ধ। আমার দেবর অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে তাকে খুঁজে বের করতে।

মনোয়ারা আরও বলেন, পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসি ওই এনজিও সমিতি থেকে ৬০ হাজার টাকা লোন তুলেন।

জানা যায়, হাসি বেগমের নিখোঁজের বিষয়টি জানতে পেরে স্বামী মোতালেব শেখ তার শ্বশুর বাড়িতে যোগাযোগ করেন। তাকে বিষয়টি বাড়িতে জানাজানি করতে নিষেধ করেন শ্বশুর। তারা কয়েকদিনের মধ্যে বিষয়টি সুরাহা করে দেবেন বলেও আশ্বাস দেন। স্ত্রীকে নিয়ে সংসার করতে হবে এজন্য মানসম্মানের ভয়ে তিনি আর থানায় কোনো অভিযোগ দেননি। তবে চারদিন পর তার শ্বশুর সদরপুর থানায় মেয়ের নিখোঁজের ব্যাপারে একটি অভিযোগ করেন। পরদিন মোতালেব শেখের বাড়িতে পরিবারের লোক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সালিশও করেন।

আরও পড়ুন: জবানবন্দি দিয়ে ফের চলে গেলেন পরকীয়া প্রেমিকের কাছে 

সদরপুর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোশাররফ হোসেন বলেন, বৈঠকে এলে হাসি বেগম কারো সঙ্গে চলে গেছে এমন একটি কথাই হইছিল। তখন তার স্বামী বলেন, সে যখন চলেই গেছে যাক, তাহলে তার সঙ্গে আমার যে ঝামেলা আছে তা পরিষ্কার করে দেন। পরদিন মোতালেব শেখ থানায় একটি অভিযোগ করেন স্ত্রীর বিরুদ্ধে। তাতে তিনি উল্লেখ করেন, তার স্ত্রী বাড়ি থেকে সোনা গহনা ও টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়েছেন।

এদিকে ২০ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পাশের ভাঙ্গা উপজেলার মানিকদহ ইউনিয়নের আদমপুর এলাকার নাউটানায় একটি ডোবা থেকে এক নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর খবর দেওয়া হয় হাসির বাবা ও স্বামীকে।

হাসি বেগমের মা সালমা বেগম বলেন, মরদেহটি দেখেই বলেছি আমার মেয়ের না। হাসির বাবা শানাক্ত করতে পারেননি। তবে মরদেহের পায়ের দুটি আঙুল ছোট ছিল, যার সঙ্গে মেয়ের কিছুটা মিল আছে।

হাসির ফুফু নিহারন বেগম বলেন, হাসির কোমড়ে একটি তাবিজ দিয়েছিলাম যেটি ওই মরদেহের কোমড়েও আছে। তাদের এসব তথ্যের ভিত্তিতেই ভাঙ্গা থানা পুলিশ মরদেহ শনাক্ত করে বৃহস্পতিবার ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। যাওয়ার পথে লাশবাহী নসিমনটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। শুক্রবার হওয়ায় মরদেহ ফরিদপুর মেডিকেলের মর্গে রাখা হয়। পচাঁ-গলা মরদেহ দুদিন পড়ে থাকার পর শনিবার ময়নাতদন্ত করা হয়। হাসির বাবার সঙ্গে থানায় যাওয়া লুৎফর রহমান নামে এক ব্যক্তি তখন পুলিশকে বলে, যদি এটি হাসির মরদেহ না হয় এবং পরে হাসি জীবিত ফিরে এলে তাহলে কী হবে? জবাবে পুলিশ জানায়, আমরা মরদেহের পরিচয় শনাক্তের জন্য ডিএনএ সংরক্ষণ করে রেখেছি।

জানতে চাইলে হাসির বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, সার্কেল অফিস থেকেই ’ই’ করছিলো। আমার তখন মাথা ঠিক ছিলোনা। আমার ভুল হয়ে গেছে।

মোতালেব শেখ বলেন, আমি খবর পেয়ে মইনুট ঘাট হয়ে বাড়িতে এসে আমার পরিবারের লোকদের নিয়ে ভাঙ্গায় যাই। তবে আমার যেতে দেরি হওয়ায় পুলিশ আমাকে সন্দেহ করে আটকায়। আমাকে বলে যেই রামদা দিয়ে খুন করেছিস সেটি কোথায়? তুই একাই এতোগুলো কোপ কীভাবে দিলি? আমি বারবার তাদের বলেছি আমি খুন করিনি। কিন্তু তারা আমার কোনো কথাই শুনেনি। এমনকি আমাকে ওই লাশটিও দেখতে দেয়নি। এরপর আমাকে সদরপুর থানায় নিয়ে হাজতে রাখে। সেখানে দু-তিন ঘণ্টা পরপর আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতো। আমার হাত দেখে বলে, এতো তাড়াতাড়ি হাতের রেখা মুছে যায় নাকি মানুষের? আমাকে নানাভাবে ভয় দেখায়। বলে রাত ১২টার পর তোকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই আসল তথ্য বেরিয়ে আসবে। আমি তাদের বারবার বলেছি আমি এর সঙ্গে জড়িত না। আমার কথা শোনেনি। থানায় ৭২ ঘণ্টা আটক রাখার সময় তারা আমাকে কোনো খাবারও দেয়নি। বাড়ি থেকে খাবার পাঠিয়েছে। তবে বাড়ির লোকদের সঙ্গে কথা বলতে দেয়নি।

মোতালেব শেখের বড় ভাই হালিম শেখ বলেন, হাসির ওই কথিত মরদেহ দাফনের সময় আমার ছোটভাইকে আনার কথা বললে হাসির বাবা টাকাপয়সা চান। হাসির বাবার হাতে ৩০ হাজার টাকা দেই ছোট ভাইকে ছাড়িয়ে আনার জন্য।

টাকার বিষয়ে স্বীকার করেছেন হাসির বাবা হাবিবুর রহমান। তবে দাবি করেন, ওই টাকা তারাই ইচ্ছা করে দেন।

এদিকে মরদেহ দাফনের পর হাসি তার বাড়িতে ফোন করে জানান, তিনি মারা যাননি জীবিত আছেন। খবর পেয়ে পুলিশ তার অবস্থান শনাক্ত করে ময়মনসিংহের নান্দাইল থেকে প্রেমিক মোস্তাকের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। এ সময় হাসির স্বামী সদরপুর থানায় আটক ছিলেন। স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি না হলেও হাসিকে স্বামীর বদলে আদালতের মাধ্যমে বাবার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়। হাসি ছাড়া পাওয়ার পর মুক্তি পায় মোতালেব। পুরো ঘটনাকালেই এই প্রবাসী তার প্রতি চরম অবিচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে ন্যায়বিচার দাবি করেন। একইসঙ্গে এমন আচরণ যেন আর কারও সঙ্গে না হয় সে দাবিও করেন।

এ বিষয়ে সদরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন আল রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ভাঙ্গা থানায় একটি মরদেহ উদ্ধারের খবর পাওয়ার পর আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি হাসি নামে একটি মেয়ের নিখোঁজের জিডি হয়েছে থানায়। তখন হাসির বাবা ও ফুফু মরদেহটি শনাক্ত করেন। হাসির স্বামীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয় তবে তাকে আটক করা হয়নি।

হাসির স্বামীর অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে বলেছে ১০ লাখ টাকা ও সোনাগহনা নিয়ে গেছে তার স্ত্রী? সে একজন গরিব মানুষ। এত টাকা সে কোথায় পাবে? তাই আমরা তার অভিযোগ বিশ্বাস করিনি। আমরা আইনগত প্রক্রিয়াতেই পরে হাসির সন্ধান পাওয়ার পর তাকে ছেড়ে দিয়েছি। আর আদালতে হাসি তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য জবানবন্দি দেওয়ায় তার বাবার জিম্মায় মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর সে স্বেচ্ছায় নিজের ইচ্ছামতো জায়গায় চলে গেছে।

তবে তালাক না হওয়ায় হাসিকে বাবার পরিবর্তে স্বামীর জিম্মায় ছেড়ে দেওয়াই আইনসঙ্গত বলেও দাবি করেন ওসি।

এসজে/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।