বৈরী আবহাওয়া, আরও বাড়তে পারে আলুর দাম
গত মৌসুমে আলুর সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল শত টাকা। রেকর্ড সৃষ্টি করা এ দামে ফড়িয়াদের কারণে কৃষকরা খুব একটা লাভবান হননি। তারপরও অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে হাটে দাম ও চাহিদা দুটোই ছিল বেশি। যে কারণে এবার বেশ আগেই কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা। কিন্তু বৈরী আবহাওয়া তাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তীব্র শীত আর ঘন কুয়াশায় অনেক এলাকায় আলুগাছে পচন রোগ দেখা গেছে। জমিতে গাছ শুকিয়ে গোড়া হলুদ বর্ণ হয়ে নুইয়ে পড়ছে।
শুরুতেই আবহাওয়ার এ বৈরিতায় চাষিরা মারাত্মক ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন। তাদের মতে, তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশায় এবছর আলুর ফলনে বিপর্যয় হলে তারা মাঠে মারা পড়বেন। কারণ প্রতিবারের তুলনায় এবার আলু রোপণে খরচ হয়েছে বেশি। গাছ না বাঁচলে আলুর ফলন অনেক কম হবে, আর দামও বাড়বে। সরেজমিন বগুড়া, জয়পুরহাট ও নওগাঁ জেলা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে দুই দফা শৈত্যপ্রবাহ, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও ঘন কুয়াশার কারণে আলুক্ষেতে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। কৃষকরা বলছেন, চাষের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আলুর জমিতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। তবে গাছ পুষ্ট হওয়ার পর এখন ঘন কুয়াশা ও দুই দফা মৃদু বৃষ্টির কারণে আলুগাছে পচন ধরেছে। এছাড়া টানা কুয়াশায় লেট ব্লাইট রোগে গাছ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অনেক স্থানেই গাছের পাতা কুঁকড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে হলুদ বিবর্ণ হয়ে গোড়া পচন রোগতো রয়েছেই। কৃষি বিভাগের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে জমিতে ছত্রাকনাশক স্প্রে করে কিছুটা প্রতিকার পেলেও কুয়াশা তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর লেট ব্লাইট রোগ হলে জমির অপরিপক্ব আলু তুলে ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্দ্র অবস্থায় লেট ব্লাইট রোগ দেখা দেয়। যদি উপযুক্ত ছত্রাকনাশক ব্যবহার না করা হয় তাহলে প্রথমবার এ রোগ দেখা দেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে পুরো গাছকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এ রোগ আলুর কাণ্ডগুলো নরম করে, পচা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় আর তা দ্রুত পাশের আলুগুলোতে দুর্গন্ধ ছড়াতে ও পচে ফেলতে সাহায্য করে।
বগুড়া আবহাওয়া অফিসের উচ্চমান পর্যবেক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, আগামীতে শীতের তীব্রতা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাপমাত্রা কমে গেলে শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, বৃহত্তর বগুড়া অঞ্চলে গত এক দশকের তুলনায় রাতের তাপমাত্রা বেশি কমে যাচ্ছে। সবশেষ বগুড়ায় ১৪ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হলেও জয়পুরহাটে এ তাপমাত্রা ছিল ১৪ ডিগ্রি। এছাড়া ঘন কুয়াশা আরও কয়েকদিন স্থায়ী হতে পারে।
আগে আলু আবাদের প্রধান এলাকা ছিল বৃহত্তর বগুড়া (বগুড়া-জয়পুরহাট)। আর এখন উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি জেলায় আলুর ভালো ফলন হচ্ছে। চাষযোগ্য জমিও প্রতিবছর বাড়ছে। উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর ও দিনাজপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতায় তিন লাখ ৫০ হেক্টরে আলু আবাদের টার্গেট করে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৯০ লাখ মেট্রিক টন। গত মৌসুমে আলু চাষ হয় ৫৩ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয় ১২ লাখ ২৫ হাজার ১৮০ টন।
জয়পুরহাটে গত মৌসুমে আলুর আবাদ হয় ৩৮ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদিত হয়েছে ৯ লাখ ২৪ হাজার ৭৬০ টন। এবার এ দুই জেলাতেই আলু চাষের জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার হেক্টর। মাটির গুণগতমানের কারণে এ অঞ্চলে অস্টেরিকা, কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, লাল পাকড়ি জাতের আলুর ফলন হয় সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি লাল আঠালো আলু ‘হাগরাই’ চাষ হয় এখানে।

বেড়েছে উৎপাদন খরচ
গতবছরে আলু বাজার বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। সে কারণে এবার আলু চাষের প্রতিটি উপকরণের দাম বেড়েছে। সার, কীটনাশক, সেচ ও আলুর বীজের দাম বেড়ে যাওয়ায় চাষ খরচ হয়ে গেছে দ্বিগুণ।
বগুড়ার মহাস্থান এলাকার কৃষক আজমল মিয়া বলেন, ‘এবছর বীজ আলুর দাম বেড়েছে। সরকারি বীজের দামও গতবছরের তুলনায় বেড়েছে ১২ টাকার বেশি। বস্তাপ্রতি সারের দাম বেড়েছে ৩০০-৪০০ টাকা পর্যন্ত। জ্বালানি তেলের দাম কয়েক দফা বেড়ে যাওয়ায় জমি চাষ ও সেচের খরচ বেড়ে গেছে।
তিন বিঘা আলু লাগিয়েছেন মহাস্থানের কৃষক ফজলার রহমান। এতে তার খরচ হয়েছে ৮২ হাজার টাকা। অথচ গতবছর একই জমিতে তার খরচ হয়েছিল ৪৭ হাজার টাকা।
ফজলার রহমান বলেন, এক বস্তা এস্টারিক্স বীজ আলু এক হাজার টাকায় কিনেছি। এবার কিনতে হচ্ছে ১৫৫০ টাকায়। এক বস্তা লাল বীজ আলুর দাম ছিল দুই হাজার টাকা। তার দাম এখন বেড়ে হয়েছে চার হাজার টাকা। এছাড়া প্রতি বস্তা সারের দাম বেড়েছে ৪০০-৪৫০ টাকা। এসব কারণে প্রতিবিঘা আলু চাষের খরচ ১৩-১৪ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ২৬-২৭ হাজার টাকা হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘এখন দাম সমন্বয় করে বাজারে বিক্রি করতে হবে। আবহাওয়ার কারণে গাছ নষ্ট হলে হয় আমরা মারা পড়বো, নয়তো ভোক্তাকে বেশি দামে আলু কিনতে হবে।’
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার কলিংগা গ্রামের কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, তাদের ৫০ বিঘা জমির আলু বীজ অবস্থায় পচে গেছে। ডিলার নকল বীজ দিয়েছেন বলে সন্দেহ করছেন তারা। বৈরী আবহাওয়ার কারণে এমনতেই তারা আলুক্ষেত নিয়ে চিন্তায় আছেন; এরমধ্যে নকল বীজ তাদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মতলুবর রহমান জানান, গত মৌসুমে বগুড়ায় টার্গেটের চেয়ে বেশি জমিতে আলু আবাদ হয়। উৎপাদন হয় ১৪ লাখ মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে আলু আবাদের টার্গেট ধরা হয়েছে ৫৮ হাজার হেক্টর জমি। উৎপাদন আশা করা হয়েছে ১৩ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এরসঙ্গে আগাম আলুর আবাদ শুরু হয়েছে অন্তত ১২ হাজার হেক্টর জমিতে।
তিনি বলেন, শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশা থাকলে আলুক্ষেতে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। তাদের মাঠ কর্মীরা সারাদিন মাঠপর্যায়ে ঘুরে ঘুরে কৃষকদের সচেতন করাসহ পরামর্শ দিচ্ছেন।
এসআর/এমএস