৪ বছরের ব্যবধানে ইলিশ উৎপাদন কমেছে ৯ শতাংশ
দেশে ইলিশ আহরণ ২০২০-২১ অর্থবছরের আগে ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও এরপর তা ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। গত চার বছরের ব্যবধানে মাছটির উৎপাদন কমেছে নয় শতাংশের বেশি। যে কারণে এবারও বাজারে ইলিশের দাম কমছে না।
সারা দেশে ইলিশের প্রাপ্যতা, মূল্য ও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এ সময় বক্তব্য দেন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
উপদেষ্টা বলেন, ‘ইচ্ছে থাকলেও এবার কম দামে ইলিশ খাওয়াতে পারিনি। প্রাকৃতিকভাবে এবারও উৎপাদন কম হলো। আমি দুঃখ প্রকাশ করছি। সদিচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করতে পারিনি।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২৫ সালের জুনের মাঝামাঝি সময়ে জাটকা আহরণের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল বাজারে ইলিশের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সেটি হয়নি।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য দিয়ে উপদেষ্টা জানান, এ বছরের জুলাই ও আগস্টে ইলিশ আহরণ ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় যথাক্রমে ৩৩ দশমিক ২০ এবং ৪৭ দশমিক ৩১ শতাংশ কম হয়েছে। চলতি বছরের এ দুই মাসে মোট আহরণ হয়েছে ৩৫ হাজার ৯৯৩ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন, যা ২০২৪ সালের তুলনায় ২২ হাজার ৯৪১ দশমিক ৭৮ টন বা ৩৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ কম।
সার্বিকভাবে ২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত ইলিশ আহরণ ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট আহরণ ছিল পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ টন। যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে হয় পাঁচ লাখ ১২ হাজার ৮৫৮ টন। অর্থাৎ, আহরণ কমেছে ৫২ হাজার ৩২৫ টন বা সোয়া নয় শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এআরআইএমএ (২.২.১) মডেল অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ সালে ইলিশ উৎপাদন পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার থেকে পাঁচ লাখ ৪৫ হাজার টন হতে পারে। তবে উৎপাদন হ্রাসের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে প্রকৃত উৎপাদন আরও কম হতে পারে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
কেন কমছে ইলিশ
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সাগর ও নদীতে ইলিশের উৎপাদন হ্রাসের পেছনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। এ মাছের জীবনচক্রের জন্য সমুদ্র ও নদী উভয় পরিবেশ অপরিহার্য। পরিপক্ক মা ইলিশ ডিম ছাড়ার জন্য সমুদ্র থেকে মোহনা হয়ে স্বাদুপানির নদীতে প্রবেশ করে। পরে ডিম ফুটে লার্ভা বড় হয়ে সমুদ্রে ফিরে যায় এবং পরিপক্কতা অর্জন করে। জাতীয় উৎপাদনের প্রধান অংশ বরিশাল বিভাগ থেকে আসে, যা প্রতি বছর মোট উৎপাদনের ৮৫ শতাংশের বেশি অবদান রাখে।
ইলিশের টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক পরিভ্রমণ পথগুলো, যেমন মেঘনা-তেতুলিয়া মোহনা অক্ষুণ্ণ রাখা অত্যন্ত জরুরি। ভোলা-নোয়াখালী ও ভোলা-পটুয়াখালীর মধ্যবর্তী মোহনা ইলিশের বৃহত্তম প্রজনন ও পরিভ্রমণ পথ হিসেবে বিবেচিত। তবে এ মোহনায় অসংখ্য চর ও ডুবোচর রয়েছে, যেগুলোর অনেকের বয়স ২০-৩০ বছর। জোয়ারের সময় এগুলো চার-পাঁচ হাত পানির নিচে থাকে এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে, যা নদীর নাব্যতা ও প্রজনন পরিবেশের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। ডুবোচরে পলি জমার কারণে নদীর গভীরতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে আধা থেকে ৭৫ ফুট পর্যন্ত পরিবর্তনশীল হয়ে থাকে, যা নদীর নাব্যতা-সংকটের স্পষ্ট প্রমাণ।

ইলিশ আহরণের অন্যতম প্রধান বাধা হচ্ছে অবৈধ জাল এবং স্থায়ী ফাঁদ জালের ব্যবহার। অবৈধ জালের মধ্যে কারেন্ট জাল, মশারি জাল, ফাঁদ জাল ইত্যাদির ব্যবহার বেড়েছে; যার ফলে বিপুল পরিমাণ জাটকা ধরা হচ্ছে। মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ (সংশোধিত ২০২০) অনুযায়ী এসব জাল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এ আইন প্রয়োগে জেলা প্রশাসন, মৎস্য দপ্তর, নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ড যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ জাল ও জাটকা জব্দ করছে। তবুও সম্পূর্ণভাবে অবৈধ আহরণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড গত ১ মে থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১৭ হাজার ৩৭৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে এবং এ সময় ৬৩১ জেলেকে আটক করা হয়। অভিযানে ১১৭ কোটি ৩৮ লাখ মিটার বিভিন্ন ধরনের অবৈধ জাল, চার লাখ ৭৯ হাজার বেহন্দি জাল, এক লাখ ১৩ হাজার কেজি জাটকা, ২৮টি বোট এবং ১৬১টি ট্রলিং বোট জব্দ করা হয়। এসব অভিযান ও জব্দের ফলে তিন লাখ ৭০ হাজার ৩৬৫ টন মাছ রক্ষা পেয়েছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ১৮ হাজার ৫১৮ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, দেশে ইলিশ আহরণ কমে যাওয়া প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট উভয় কারণের ফল। অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের পরিবেশগত পরিবর্তন, বিশেষ করে বিভিন্ন নদ-নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ ও কালভার্ট-সেতু নির্মাণ, উজান থেকে পরিবাহিত পলি জমা এবং নদীর নাব্যতা হ্রাস ও জলজ পরিবেশ দূষণ ইলিশ আহরণের প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ফলে ইলিশ মাছের পরিভ্রমণ পথ, প্রজননক্ষেত্র, বিচরণ ও চারণক্ষেত্র দিন দিন পরিবর্তিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যার কারণে দেশের নদ-নদীতে ইলিশের প্রাপ্যতা হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া, নির্বিচারে ক্ষতিকর জাল ব্যবহারের ফলে এবং অপরিকল্পিত যান্ত্রিক নৌযানের মাধ্যমে মাছ আহরণ ইলিশের উৎপাদন হ্রাসের অন্যতম কারণ। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তমন্ত্রণালয় কার্যক্রম নেওয়া প্রয়োজন এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় অবিলম্বে উদ্যোগ নেবে।
ইলিশ রপ্তানি পরিস্থিতি
বাংলাদেশ থেকে ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ইলিশ রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে সম্পন্ন হয়। ২০১০-১১ সালে আট হাজার ৫৩৮ দশমিক ৭৭ টন রপ্তানির মাধ্যমে ৩৫২ দশমিক ৪৯ কোটি টাকা এবং পরের বছর ছয় হাজার ১৭৩ দশমিক ৬৫ টন রপ্তানি হয়ে ২৯৪ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। তবে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০১২ সালের ৩১ জুলাই রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে স্বল্প পরিসরে ও শর্তসাপেক্ষে ভারতে ইলিশ রপ্তানি শুরু হয়, যা কেবল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে সম্পন্ন হচ্ছে। তবে ইলিশের প্রাপ্যতা কম থাকায়, অনুমোদিত পরিমাণ মাছ রপ্তানি করতে রপ্তানিকারকেরা সবসময় সক্ষম হননি। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে এক হাজার ২০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হলেও ১৬ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে মাত্র ৮১ দশমিক ৪৩৮ টন রপ্তানি হয়েছে।
ভারতে রপ্তানির পাঁচ বছর
২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানির জন্য অনুমোদনের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৭৫ টন আর প্রকৃত রপ্তানি হয় সমপরিমাণ, যার মূল্য ছিল ১৫৪ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর অনুমোদনের পরিমাণ চার হাজার ৬০০ টন হলেও প্রকৃত রপ্তানি হয় এক হাজার ২১১ টন, যার রপ্তানি মূল্য ১১৩ কোটি টাকা। এর পরের বছর তিন হাজার টনের অনুমোদন দেওয়া হলেও ১৪৮ কোটি টাকা মূল্যে রপ্তানি হয় এক হাজার ৩৭৬ টন।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে তিন হাজার ৫৫০ টন অনুমোদনের বিপরীতে প্রকৃত রপ্তানি হয় ৬৬৫ মেট্রিক টন, যার রপ্তানি মূল্য ছিল ৮৫ কোটি টাকা। তার পরের অর্থবছরে দুই হাজার ৪২০ টনের অনুমোদন দেওয়া হলেও প্রকৃত রপ্তানি ছিল ৬৮ কোটি টাকা মূল্যের ৫৭৪ টন। সর্বশেষ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এক হাজার ২০০ টন অনুমোদনের বিপরীতে প্রকৃত রপ্তানি চলমান।
রপ্তানির বাজার মূল্য
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি কেজি ইলিশের রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করেছে সাড়ে ১২ ডলার। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ডলারের ক্রয়মূল্য ছিল ১২১ দশমিক ৭২ টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী, তখন পর্যন্ত বেনাপোল দিয়ে ভারতে রপ্তানি করা ৮১ হাজার ৪৩৮ কেজি ইলিশের বাজার মূল্য দাঁড়াচ্ছে ১২ কোটি ৩৯ লাখ ৭ হাজার ৯১৭ টাকা। অন্যদিকে, আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ১৮ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ২২ দশমিক ২৬ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, যার বর্তমান বাজার মূল্য দাঁড়ায় তিন কোটি ৩৮ লাখ ১৫৪ টাকা।
এনএইচ/একিউএফ/এএসএম