চাপে শেয়ারবাজার, অনিশ্চয়তায় আটকে বিনিয়োগকারীরা
দেশের শেয়ারবাজার বর্তমানে এক ধরনের স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। সূচকের ওঠানামা থাকলেও সামগ্রিকভাবে বাজারে গতি নেই, লেনদেন সীমিত এবং বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ এখনো সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। দীর্ঘ মন্দার কারণে অধিকাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারী বড় লোকসানের মধ্যে রয়েছেন। অনেকেই মাসের পর মাস লেনদেনে অংশগ্রহণ করছেন না। এ অবস্থা থেকে কবে মুক্তি পাবেন তারও কোনো দিশা পাচ্ছেন না তারা। সবমিলিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় আটকে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
বিনিয়োগকারীরা বলছেন, অব্যাহত পতনের কারণে লোকসানের পাল্লা এতটাই ভারী হয়েছে, পোর্টফোলিওতে থাকা শেয়ার বিক্রি করলে কিছুই পাওয়া যাবে না। সে কারণে তারা শেয়ার বিক্রি না করে সামনে বাজার ভালো হবে, সেই প্রত্যাশায় শেয়ার ধরে রাখছেন। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে শেয়ারবাজার তত তলানিতে যাচ্ছে। ফলে লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হচ্ছে। এতে প্রতিনিয়ত বিনিয়োগকারীদের নীরব রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের মারাত্মক আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে মাঝেমধ্যে বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিলেও তা স্থায়ী হচ্ছে না। বাজার একটু ঊর্ধ্বমুখী হলেই বিক্রির চাপ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে পতনের মধ্যেই আবদ্ধ থাকছে শেয়ারবাজার। আবার বিনিয়োগকারীদের বড় অংশ লোকসানে থাকায় তাদের ক্রয়-বিক্রের পরিমাণ কমে গেছে। এতে বাজারে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে এবং শেয়ারবাজারের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছ।
তারা আরও বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বাজারে নতুন আইপিও আসছে না, এটিও শেয়ারবাজারের জন্য একটি বড় সমস্যা। আইপিও না আসার কারণে বিনিয়োগের বিকল্প ক্ষেত্র যেমন সৃষ্টি হচ্ছে না, তেমনি বাজারে নতুন বিনিয়োগকারীও আসছেন না। আবার বাজারে মন্দা থাকায় অনেকে শেয়ারবাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে ব্যাংক আমানত, ট্রেজারি বিল ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, মাঝেমধ্যে সূচক কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হলেও তা ধরে রাখতে পারছে না। সেই সঙ্গে মাঝেমধ্যে লেনদেনের গতি কিছুটা বাড়লেও, দুই-একদিন পরেই আবার লেনদেনের গতি কমে যাচ্ছে। ফলে সার্বিকভাবে বাজারে লেনদেন খরা ও দরপতনের মধ্যে পতিত হয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম কার্যদিবস ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ছিল ৫ হাজার ২১৮ পয়েন্টে। এখন তা কমে ৪ হাজার ৮৯০ পয়েন্টে নেমেছে। অর্থাৎ চলতি বছরে এরই মধ্যে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক কমেছে ৩২৮ পয়েন্ট। এদিকে শেষ ১৩ কার্যদিবসের মধ্যে মাত্র একদিন ডিএসইতে ৫০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। অথচ কয়েক মাস আগেও ডিএসইতে হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছিল।
শেয়ারবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিনিয়োগকারী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা প্রতিদিনই আশায় থাকি বাজার ভালো হবে, কিন্তু কিছুতেই বাজার ভালো হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে বাজারে মন্দা চলছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লোকসান বেড়েই চলেছে। বর্তমানে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত লোকসানে রয়েছেন। ফলে বাজারে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।
আরেক বিনিয়োগকারী আরিফুল ইসলাম বলেন, আমি ২৮ টাকা করে বে-লিজিং কোম্পানির শেয়ার কিনেছিলাম, এখন সেই শেয়ারের দাম ৩ টাকায় নেমেছে। ৩০ টাকা করে কেনা সাইফ পাওয়ার টেকের শেয়ার দাম এখন ৫ টাকার নিচে। তাহলে বুঝে নেন কী পরিমাণ লোকসানে আছি। এক বছর হয়ে গেছে, আমি বাজারে লেনদেন করতে পারছি না। এত লোকসানে তো শেয়ার বিক্রি করা সম্ভাব না। তাই যেভাবে আছে, সেভাবেই ফেলে রেখেছি। যদি কোনো দিন বাজার ভালো হয়, তখন বিক্রি করবো।
ডিএসইর এক সদস্য বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ আশানুরূপ না। মাঝেমধ্যে লেনদেন বাড়লেও তা ধারাবাহিক হচ্ছে না। অধিকাংশ দিনেই লেনদেন সীমিত থাকছে, যা বাজারে তারল্যের সংকট নির্দেশ করে। বর্তমানে যে লেনদেন হচ্ছে, তা দিয়ে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর পক্ষে চলা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ ব্রোকারেজ হাউজগুলোর আয়ের মূল উৎস লেনদেন থেকে পাওয়া কমিশন।
তিনি বলেন, বর্তমান শেয়ারবাজারের বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিনিয়োগকারীর আস্থা। দীর্ঘদিন ধরে কাঙ্ক্ষিত রিটার্ন না পাওয়ায় অনেক বিনিয়োগকারী বাজার থেকে দূরে রয়েছেন। নতুন বিনিয়োগকারীর প্রবেশও তুলনামূলকভাবে কম। বিশেষ করে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বাজারে অনিশ্চয়তা, দরপতন এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনার অভাবে ঝুঁকি নিতে আগ্রহী হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, এক বছরের বেশি হয়ে গেছে শেয়ারবাজারে নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্তি হয়নি। আইপিও না থাকায় বাজারে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাপ শেয়ারবাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি নীতিগত সিদ্ধান্তে অস্পষ্টতা ও বাস্তবায়নে ধীরগতি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। ফলে অনেক বিনিয়োগকারী তুলনামূলক নিরাপদ খাত- যেমন ব্যাংক আমানত, ট্রেজারি বিল ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে ঝুঁকছেন, যা শেয়ারবাজারের তারল্য আরও কমিয়ে দিচ্ছে।
ডিএসইর পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিও জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের বাজারে প্রচুর চাপ আছে। বিক্রির চাপ আছে। আইসিবি তার ফান্ডগুলো ব্যবহার করতে পারছে না, আগে যে বাজে শেয়ারে বিনিয়োগ করে রেখেছিল, সেখানে একটা প্রেশার (চাপ) আছে। এই যে পাঁচটা ব্যাংক মার্জ করা হলো, তার একটা প্রেশার আছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিক্রির চাপ ছিল। এতগুলো চাপের পরও বাজার আস্তে আস্তে করে এগোচ্ছে। এখন আমরা যদি মনে করে রাতারাতি কিছু হয়ে যাবে, তা না। এতকিছুর মধ্যেও বাজারে ভালো দিক হলো- সুশাসন তৈরি হচ্ছে, আইন-কানুনের যে গ্যাপ ছিল সেগুলো ঠিক হচ্ছে। এখানে (বাজারে) আসলে অযাচিতভাবে টাকা লস করতে হবে না, মানুষের মধ্যে এই আস্থা তৈরি করতে পারলে, যে ক্ষতি বাজারে হয়ে গেছে তা ধাপে ধাপে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
এমএএস/ইএ/এএসএম