ভোমরা স্থলবন্দর
ভারতের ভিসা কড়াকড়ির প্রভাব সাতক্ষীরার পরিবহন ব্যবসায়
ভারতে যাতায়াতে বেনাপোলের পর জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর। সে জনপ্রিয়তায় ছেদ পড়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। সেই থেকে পর্যটক ভিসা পুরোপুরি বন্ধ। মেডিকেল ভিসার সংখ্যাও কম। ফলে ভোমরা দিয়ে দিনে যাতায়াতকারীর সংখ্যা একশরও নিচে নেমেছে। যার প্রভাব পড়েছে পরিবহন ব্যবসায়ও।
অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সারা দেশের মতো সাতক্ষীরায় গত বছর দেড়েক ধরে এমনিতেই ধীরগতি। ভোমরা স্থলবন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য বা কর্মসংস্থানে টিকে ছিল এমন মানুষের সংখ্যা জেলায় অনেক। ২০২৩-২৪ সালে ভারতের কলকাতা যেতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ভোমরা স্থলবন্দর। গ্রিন লাইনসহ দু-একটি পরিবহন কলকাতা পর্যন্ত সার্ভিসও চালু করে। পদ্মা সেতু হওয়ার পর ঢাকা থেকে খুব কম সময়ে সাতক্ষীরার ভোমরায় পৌঁছানো যায়। বেনাপোলের মতো ইমিগ্রেশনে সমস্যা কিংবা যাত্রীর চাপও এখানে তুলনামূলক কম হওয়ায় বহু মানুষ এ পথ বেছে নিচ্ছিলেন।

সম্ভাবনা দেখে অন্য ব্যবসার পাশাপাশি পরিবহন সেক্টরেও অনেকে বিনিয়োগ করেন। ভারতে প্রবেশে ভিসা কড়াকড়ির পর ভোমরা বন্দরকেন্দ্রিক অনেকে কাজ হারিয়েছে। বন্ধ হয়েছে অনেক ব্যবসা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পরিবহন সেক্টর। যাত্রী আকর্ষণে পরিবহনগুলো ভোমরার যাত্রী থাকলে তাদের বন্দর পর্যন্ত সার্ভিস দিতো। সাতক্ষীরায় একটি ভারতীয় ভিসা সেন্টারও ছিল যেটা সম্প্রতি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
ভোমরা দিয়ে ভারত ভ্রমণে যাত্রী খরা, ব্যবসায় ভাটা
ভোমরা স্থলবন্দরে আমদানি কমলেও বেড়েছে রাজস্ব
অবকাঠামো সংকটে থেমে আছে ভোমরা বন্দরের উন্নয়ন
ফলে সাতক্ষীরার নিকটবর্তী ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে বাণিজ্যিক ও যাত্রী যাতায়াত কমে যাওয়ায় সেখানকার পরিবহনগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রী কমেছে। কমে গেছে প্রতিদিনের নিয়মিত পরিবহনের ট্রিপের সংখ্যাও।
সারাদিনে আগে শুধু আমাদের পরিবহনে কমপক্ষে একশ যাত্রী থাকতো, যারা ভারত যাচ্ছেন বা সেখান থেকে আসছেন। কিন্তু এখন দিনে দশজনও এমন যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না।- দূরপাল্লার পরিবহন ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশন সাতক্ষীরা জেলার সভাপতি সরদার মুকুল
ওই এলাকার পরিবহন মালিক ও কর্মকর্তারা জানান, দেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের কলকাতায় যাতায়াত সবচেয়ে নিকটবর্তী। যে কারণে আগে প্রচুর সংখ্যক মানুষ এ বন্দর দিয়ে যাতায়াত করতেন, যারা সাতক্ষীরাকেন্দ্রিক পরিবহনগুলো ব্যবহার করতেন। কিন্তু ভারত ভিসা দেওয়া কড়াকড়ি করার পরে এখন এ ধরনের যাত্রীর সংখ্যা মাত্র এক-চতুর্থাংশে নেমেছে। যার প্রভাবে আশানুরূপ যাত্রী পাচ্ছে না ওই এলাকার দূরপাল্লার বাসসহ স্থানীয় পরিবহনগুলো।
তথ্য বলছে, বিগত বছরগুলোতে ভোমরা স্থলবন্দর হয়ে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার যাত্রী যাতায়াত করতেন। তবে এখন ভারতে যাওয়া ও ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা পাসপোর্টধারী যাত্রীর সংখ্যা নেমেছে শতকের ঘরে।
পরিবহন মালিকরা বলছেন, দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভারতগামী যাত্রীরা সাতক্ষীরার পরিবহন ব্যবহার করে বন্দরে আসেন, আবার ভারত থেকে ফেরা যাত্রীরা সারাদেশের নানা এলাকায় যান। আগে এমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যাত্রী ছিল ওইসব পরিবহনে, যা এখন নেই।

সেখানে কথা হয় দূরপাল্লার পরিবহন ম্যানেজার অ্যাসোসিয়েশন সাতক্ষীরা জেলার সভাপতি ও হানিফ পরিবহনের ম্যানেজার সরদার মুকুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সারাদিনে আগে শুধু আমাদের পরিবহনে কমপক্ষে একশ যাত্রী থাকতো, যারা ভারত যাচ্ছেন বা সেখান থেকে আসছেন। কিন্তু এখন দিনে দশজনও এমন যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া আগে প্রায় প্রতিটি যাত্রীর সঙ্গে তাদের সহযোগী, রিসিভার বা আত্মীয়স্বজন থাকতো। এখন সেটা নেই বলে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকা আপ-ডাউন ট্রিপে প্রায় ৫০ শতাংশ যাত্রী কমেছে।’
এইচ আর ট্রাভেলসের ম্যানেজার আব্দুল আলীম বলেন, ‘বাংলাদেশিদের পাশাপাশি আগে ভারতের মানুষ আসতো। একটি ট্রিপে কমপক্ষে দুজন হলেও ভারতীয় যাত্রী থাকতো আগে। এখন সেটা নেই।’
একই ধরনের কথা জানান সোহাগ পরিবহনের ম্যানেজার শহীদুল কবির দুলালও। তিনি বলেন, ‘দুই দেশের বৈরী সম্পর্কের কারণে আমাদের সাতক্ষীরা-ভোমরাকেন্দ্রিক পরিবহন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে বন্দর থেকে সন্ধ্যার দিকে অনেক যাত্রী কাউন্টারে আসতো। যে কারণে সাতক্ষীরা থেকে বিকেলে ও সন্ধ্যায় ঢাকাগামী অনেক পরিবহন যাতায়াত করতো। কিন্তু এখন যাত্রী না হওয়ার কারণে পরিবহনের সংখ্যা কমাতে হচ্ছে।’
এ জেলা থেকে প্রতিদিন দুইশ’র বেশি দূরপাল্লার বাস চলে। কিন্তু এখন ভোমরা স্থলবন্দর বাণিজ্যিক ও যাত্রী যাতায়াত একদম কমে যাওয়ার কারণে প্রায় সব পরিবহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাত্রী সংকটে প্রায় সব কোম্পানি বাধ্য হয়ে ট্রিপ কমিয়ে সমন্বয় করার চেষ্টা করছে।- সাতক্ষীরা দূরপাল্লার পরিবহন মালিক সমিতি সভাপতি তাহমিদ শাহেদ চয়ন
এদিকে পদ্মা সেতু চালুর আগে ও পরে সাতক্ষীরার পরিবহন খাতে বিনিয়োগ করেছিলেন অনেক ব্যবসায়ী। ঢাকা-সাতক্ষীরা রুটে চলাচলের জন্য বিগত প্রায় দুই বছরে এ এলাকায় বেশকিছু নতুন কোম্পানি বাস চালু করেছে। সাতক্ষীরা শহর ও সাতটি উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় বাসগুলো চলাচল করছে। বর্তমানে এ এলাকা থেকে ৪০টি পরিবহন কোম্পানির বাস ঢাকায় চলাচল করে। যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক স্থানীয় ব্যবসায়ীদের।

এসব পরিবহন মালিকরা বলছেন, পদ্মা সেতু চালুর পরে কিছুদিন সাতক্ষীরার গাড়ির ব্যবসাও সম্প্রসারিত হয়েছিল, যা এখন ভারত-বাংলাদেশ বৈরী সম্পর্কে মুখ থুবড়ে পড়ছে। বিনিয়োগ করে চরম হতাশায় ভুগছেন অনেক পরিবহন মালিক।
সাতক্ষীরা দূরপাল্লার পরিবহন মালিক সমিতি সভাপতি তাহমিদ শাহেদ চয়ন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ জেলা থেকে প্রতিদিন দুইশ’র বেশি দূরপাল্লার বাস চলে। কিন্তু এখন ভোমরা স্থলবন্দর বাণিজ্যিক ও যাত্রী যাতায়াত একদম কমে যাওয়ার কারণে প্রায় সব পরিবহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যাত্রী সংকটে প্রায় সব কোম্পানি বাধ্য হয়ে ট্রিপ কমিয়ে সমন্বয় করার চেষ্টা করছে। তবে এ সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে সাতক্ষীরার পরিবহন ব্যবসায় ধস নামবে।’
এনএইচ/এএসএ/এমএফএ/এমএস