শেয়ারবাজারে প্রথম আইপিওশূন্য বছর

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৭:১২ পিএম, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫
২০২৫ সালে শেয়ারবাজারে কোনো আইপিও আসেনি/ প্রতীকী ছবি

প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওকে বিবেচনা করা হয় শেয়ারবাজারের ‘নতুন রক্ত’ হিসেবে। অথচ দেশের শেয়ারবাজারে এই নতুন রক্তপ্রবাহ বা আইপিও আসা বন্ধ হয়ে গেছে। বিদায়ের পথে থাকা ২০২৫ সালে একটিও আইপিও আসেনি। দেশের শেয়ারবাজারে পুরো এক বছরে কোনো আইপিও না আসার ঘটনা এটিই প্রথম। বিষয়টিকে অস্বাভাবিক এবং দীর্ঘ মেয়াদে শেয়ারবাজারের জন্য ব্যাপক ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ করছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, নতুন আইপিও এলে শেয়ারবাজারে বিকল্প বিনিয়োগের পথ সৃষ্টি হয় এবং তারল্য বাড়ে। অতীতে যখনই বাজারে ভালো কোম্পানির আইপিও এসেছে, তখনই নতুন বিনিয়োগকারী এসেছেন এবং বাজারে তারল্য বেড়েছে। তাই বাজারে গতি ফেরাতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) নতুন ভালো কোম্পানির আইপিও আনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যদি দীর্ঘদিন আইপিও বন্ধ থাকে, তাহেল বিনিয়োগের বিকল্প পথ যেমন খুলবে না, তেমনই বিনিয়োগকারীদের আস্থাও নষ্ট হয়ে যাবে।

দেশের শেয়ারবাজারে সর্বশেষ আইপিও এসেছে টেকনো ড্রাগসের। গত বছরের (২০২৪ সালের) জুনে এই কোম্পানিটি আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে টাকা উত্তোলন করে। এরপর আর কোনো কোম্পানির আইপিও আসেনি। অর্থাৎ দেড় বছর ধরে শেয়ারবাজারে আইপিও আসা বন্ধ রয়েছে। দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় আইপিও না আসার ঘটনা আর ঘটেনি। এমনকি একটি পুরো বছরে কোনো আইপিও না আসার ঘটনাও এটিই প্রথম।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০২০ ও ২০২১ সালে পরপর দুই বছর শেয়ারবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ উত্তোলন হয়। তবে ২০২২ সালে আইপিওর সংখ্যা কমে আসে। পরের বছর ২০২৩ সালে আইপিওতে রীতিমতো ধস নামে, যা অব্যাহত থাকে ২০২৪ সালেও।

দেড় বছর ধরে শেয়ারবাজারে আইপিও আসা বন্ধ রয়েছে। দেশের শেয়ারবাজারের ইতিহাসে এত দীর্ঘ সময় আইপিও না আসার ঘটনা আর ঘটেনি। এমনকি একটি পুরো বছরে কোনো আইপিও না আসার ঘটনাও এটিই প্রথম।

২০২৪ সালে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে মাত্র চারটি কোম্পানি অর্থ উত্তোলন করে। এর মধ্যে ছিল- এনআরবি ব্যাংক, বেস্ট হোল্ডিং, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ এবং টেকনো ড্রাগস। এই চার কোম্পানির মধ্যে এনআরবি ব্যাংক স্থির মূল্য পদ্ধতিতে আইপিওতে শেয়ার বিক্রি করে। বাকি তিন কোম্পানি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারবাজারে আসে।

এনআরবি ব্যাংক আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে উত্তোলন করে ১০০ কোটি টাকা। বাকি তিন কোম্পানির মধ্যে বেস্ট হোল্ডিং ৩৫০ কোটি টাকা, এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজ ৯৫ কোটি টাকা এবং টেকনো ড্রাগস ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। অর্থাৎ চারটি কোম্পানি আইপিওতে শেয়ার ছেড়ে মোট ৬৪৫ কোটি টাকা উত্তোলন করে।

আরও পড়ুন
বছর ধরে শেয়ারবাজারে ‘নতুন রক্ত’ প্রবাহ বন্ধ
৬ মাসের কম সময়ের মধ্যে আইপিও প্রক্রিয়া শেষ করা হবে
ভালো কোম্পানির আইপিও আনতে আইন বাজারবান্ধব করতে হবে

এর আগে ২০২৩ সালে মিডল্যান্ড ব্যাংক, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, শিকদার ইন্স্যুরেন্স এবং ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড আইপিওতে আসে। অর্থাৎ ২০২৩ সালে আইপিওতে আসে তিনটি কোম্পানি এবং একটি মিউচুয়াল ফান্ড। এর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংক ৭০ কোটি টাকা, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি টাকা, শিকদার ইন্স্যুরেন্স ১৬ কোটি টাকা এবং ক্যাপিটেক গ্রামীণ ব্যাংক গ্রোথ ফান্ড ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করে। অর্থাৎ চারটি প্রতিষ্ঠানের উত্তোলন করা অর্থের পরিমাণ ছিল ২০২ কোটি টাকা।

আমাদের বাজারে বিনিয়োগকারী খুবই কম, ট্রেডার বেশি। একজন বিনিয়োগকারী আইপিওর মাধ্যমে প্রথমে শেয়ারবাজার সম্পর্কে জানেন, তারপর বিনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে তিনি বড় বিনিয়োগকারীদের একজনে পরিণত হন। -ডিএসই পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিও

পরপর দুই বছর মাত্র চারটি করে প্রতিষ্ঠান আইপিওতে এলেও ২০২২ সালে ছয়টি প্রতিষ্ঠান আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করে। এই ছয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল ৬২৬ কোটি ২৬ লাখ ৯ হাজার টাকা। তার আগে ২০২১ সালে আইপিওর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৫টি। এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮৫৮ কোটি ৪৪ লাখ ৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রিন সুকুকই উত্তোলন করে ৪২৫ কোটি ৭ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

এছাড়া ২০২০ সালে আটটি প্রতিষ্ঠান ৯৮৫ কোটি ৮৭ লাখ ২৩ হাজার টাকা উত্তোলন করে। তার আগে ২০১৯ সালে নয়টি প্রতিষ্ঠান ৬৫২ কোটি টাকা, ২০১৮ সালে ১৪টি প্রতিষ্ঠান ৬০১ কোটি টাকা, ২০১৭ সালে আটটি প্রতিষ্ঠান ৪১৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৬ সালে ১১টি প্রতিষ্ঠান ৮৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ২০১৫ সালে ১২টি প্রতিষ্ঠান ৮৩০ কোটি ৭২ লাখ ২১ হাজার টাকা, ২০১৪ সালে ২০টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ২৬৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ২০১৩ সালে ১২টি প্রতিষ্ঠান ৮৩০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১২ সালে ১৭টি প্রতিষ্ঠান উত্তোলন করে এক হাজার ২০৮ কোটি ১০ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। ২০১১ সালে ১৩টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ৬৭৭ কোটি ৭১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, ২০১০ সালে ১৮টি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ১৮৬ কোটি ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ২০০৯ সালে ১৭টি প্রতিষ্ঠান ৪৩৫ কোটি ৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকা আইপিওর মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে উত্তোলন করে।

আইপিও পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক রিচার্ড ডি রোজারিও জাগো নিউজকে বলেন, ‘সবাই বলে এবং বাস্তবতাও তাই- আইপিও ছাড়া কোনো শেয়ারবাজার হতে পারে না। আইপিও ছাড়া তো শেয়ারবাজার কল্পনাই করা যায় না। আইপিও শেয়ারবাজারের জন্য অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইপিও না আসা আমাদের বাজারের জন্য একটা বিরাট বড় লু ফলস।’

তিনি বলেন, ‘আইপিওর মাধ্যমে জনগণকে অফার করা হয়। একটি ভালো আইপিও এলে তার সঙ্গে সঙ্গে অনেক বিনিয়োগকারী আসেন। অবশ্যই ভালো আইপিও আসতে হবে। খারাপ আইপিও এলে কিন্তু বিনিয়োগকারী আসে না। যখন গ্রামীণফোন, ওয়ালটন, স্কয়ার ফার্মা, রবি এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আইপিও এসেছে- তখন বাজারে অনেক বিনিয়োগকারী এসেছেন। যতবার বাজারে ভালো কোম্পানির আইপিও এসেছে, ততবার বাজারে নতুন নতুন বিনিয়োগকারী এসেছেন।’

আরও পড়ুন
পতনের মধ্যেই শেয়ারবাজার, লেনদেন নেমেছে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে
শেয়ারবাজারে প্রেফারেন্স শেয়ারের লেনদেন শুরু
অবমূল্যায়িত শেয়ারবাজার, ‘ঝুঁকিতে’ চামড়া-সিরামিক

রিচার্ড ডি রোজারিও আরও বলেন, ‘আমাদের বাজারে বিনিয়োগকারী খুবই কম, ট্রেডার বেশি। একজন বিনিয়োগকারী আইপিওর মাধ্যমে প্রথমে শেয়ারবাজার সম্পর্কে জানেন, তারপর বিনিয়োগ করেন। পরবর্তীতে তিনি বড় বিনিয়োগকারীদের একজনে পরিণত হন।’

আইপিও হলো শেয়ারবাজারের নিউ ব্লাড। নিউ ব্লাড প্রবাহ যদি বাজারে বন্ধ হয়, তাহলে এটা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাপক ক্ষতি করে। এর ফলে বাজার অনেক পিছিয়ে যায়, বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়। - ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম

আগামী বছরে আপনারা কী প্রত্যাশা করছেন? এমন প্রশ্ন করা হলে ডিএসই পরিচালক বলেন, ‘প্রত্যাশা করার আগে অনেকগুলো জিনিস ঠিক করতে হবে। আশার আগে যদি ক্ষেত্র তৈরি না হয়, তাহলে আশাটা আশাই থেকে যাবে।’

‘আমাদের এখানে অনেক চাপ আছে। বিক্রির চাপ আছে। আইসিবি তার ফান্ডগুলো ব্যবহার করতে পারছে না, আগে যে বাজে শেয়ারে বিনিয়োগ করে রেখেছিল, সেখানে একটা চাপ আছে। এই যে পাঁচটা ব্যাংক মার্জ করা হলো, তার একটা চাপ আছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিক্রির চাপ ছিল। এতগুলো চাপের পরও বাজার ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।’

ডিএসইর এই পরিচালক আরও বলেন, ‘এখন আমরা যদি মনে করি রাতারাতি কিছু হয়ে যাবে, তা নয়। এতকিছুর মধ্যেও বাজারে ভালো দিক হলো সুশাসন তৈরি হচ্ছে, আইন-কানুনের যে গ্যাপ ছিল সেগুলো ঠিক হচ্ছে। এখানে (শেয়ারবাজারে) এলে অযাচিতভাবে টাকা লোকসান করতে হবে না, মানুষের মধ্যে এই আস্থা তৈরি করতে পারলে এবং কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের ওপর মানুষের আস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে, যে ক্ষতি বাজারে হয়ে গেছে তা ধাপে ধাপে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইপিও হলো শেয়ারবাজারের নিউ ব্লাড (নতুন রক্ত)। নিউ ব্লাড প্রবাহ যদি বাজারে বন্ধ হয়, তাহলে এটা দীর্ঘ মেয়াদে ব্যাপক ক্ষতি করে। এর ফলে বাজার অনেক পিছিয়ে যায়, বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়।’

তিনি বলেন, ‘নতুন ভালো কোম্পানির আইপিও এলে বাজারে যেমন নতুন বিনিয়োগকারী আসেন, তেমনই বাজারে তারল্য বাড়ে। বিনিয়োগকারীদের বিকল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়, বাজারের গভীরতা বাড়ে। নতুন কোম্পানির আইপিও আনার উদ্যোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে নিতে হবে। কেন আইপিও আসছে না, তা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে খুঁজে বের করতে হবে এবং তার আলোকে কাজ করতে হবে।’

এমএএস/কেএসআর/এমএমএআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।