অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ
গত বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন বছরের শুরুতে আবারও হরতাল-অবরোধে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ চলছে। আবারও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য।
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, হরতাল, অবরোধসহ রাজনৈতিক সহিংসতা থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের বিপর্যয় আসবে। দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। সার্বিক প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে না।
নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির জেরে বিএনপি অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ঘোষণা করেছে। সহিংসতায় এরই মধ্যে কয়েকজন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গত ৬ জানুয়ারি থেকে বিএনপির টানা অবরোধে চলছে এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে ব্যবসায়ীরা পথে বসে যাবেন।
জানতে চাইলে ব্যবসায়িদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ জাগোনিউজকে বলেন, অবশ্যই সংঘাত ও নেতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচি বিশেষ করে হরতাল-অবরোধের পরিহার করা উচিত। কেননা এ ধরনের কর্মসূচি অর্থনীতির জন্য হুমকিস্বরূপ। একদিনের কর্মূচিতে দেশের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এর দায়িত্ব কে নেবে।
তিনি বলেছেন, গত কিছুদিনের অবরোধ কর্মসূচিতে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ কর্মসূচিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবহন, উৎপাদন এবং পর্যটন খাত। অবরোধের কারণে পরিবহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ২ লক্ষেরও বেশি বাস, ট্রাক, কাভার্ডভ্যান অলস পড়ে আছে এবং ২০ লাখেরও বেশি পরিবহন শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে পরিবহন খাতে দৈনিক প্রায় ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, পরিবহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় শুধুমাত্র যাত্রীদেরই ভোগান্তি হচ্ছে না এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে উৎপাদন এবং পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায়। পরিবহন না থাকায় কৃষি পণ্য সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটছে যার কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। কাঁচামাল সরবরাহ না হওয়ায় উৎপাদন কর্মকাণ্ড ও ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প পুঁজিহারা হচ্ছে। বৃহৎসহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটছে। পরিবহন ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায় পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে যার প্রভাব পণ্যমূল্যের উপর পড়ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক শান্তি দরকার। আমাদের ব্যবসায়ির পণ্য যাতে ট্রাকে বন্দরে যেতে পারে, দোকানদার তার দোকান খোলা রাখতে পারেন, সেটি জরুরি।
গবেষণা সংস্থা ও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো মনে করেন, মূলত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে গত অর্থবছরে কাঙ্ক্ষিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়নি। গত অর্থবছরে জিডিপির অংশ হিসেবে বেসরকারি বিনিয়োগ তার আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে গেছে।
জানা গেছে, সরকার চায় রপ্তানি বাড়াতে। আগামীতে রপ্তানি কিছুটা বাড়বে বলে মনে হচ্ছিল। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহও আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। বাড়ছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি। অর্থনীতিতে গতি ফিরে পাওয়ার এ সময়ে ফের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সবাই।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির পর্যালোচনা মতে, ২০১৩ সালের শেষার্ধে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতের পরিণতিতে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা ২০১৪ সালে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে নেতিবাচক প্রভাব রেখেছে। এর ফলে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে উৎপাদন খাতের প্রবৃদ্ধি তার আগের বছরের চেয়ে কম হয়। আবারও একই সংশয় দেখা দিয়েছে।
বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম বলেন, এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে। রফতানি পণ্য উৎপাদন হরতাল-অবরোধের আওতামুক্ত থাকলেও ঠিকভাবে সরবরাহ করতে না পারায় রফতানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
তবে টানা অবরোধে সারা নেই বললেই চলে। মানুষ প্রয়োজনে রাস্তায় নেমে আসছে। চলছে গাড়ি। খুলছে দোকানপাট। দোকানপাট খোলা রাখলেও বেচাকেনা না থাকায় ক্ষতিতে পড়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
তৈরি পোশাক রপ্তনিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন ৫০০ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হচ্ছে। অরবোধে এসব পণ্য রফতানি ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাধার মুখে ব্যবসা-বাণিজ্য। প্রতিদিন গড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। এ অস্থিরতায় বেচাকেনা তো হচ্ছে না, উল্টো দেড়শ` কোটি টাকার ক্ষতিতে পড়তে হচ্ছে। বন্ধ থাকলেও বিদ্যুৎ বিল, দোকান ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দিতে হচ্ছে।
এদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা চলমান অবরোধ তথা রাজনৈতিক অস্থিরতা কতদিন চলবে এবং অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে, এমনই উদ্বিগ্নে রয়েছে ব্যবসায়ীরা।
আরএস/ এমএএস