সূর্যমুখী ফুলে জাগছে আশা
# লাভবান হওয়ায় কৃষকরা ঝুঁকছেন চাষে
# সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যের বীজ ও সার
# আমদানিনির্ভরতা কমাবে সয়াবিন তেলের
আগে শখের বাগানের দেখা মিললেও এখন মাঠে মাঠে হাসির ঝিলিক ছড়াচ্ছে সূর্যমুখী ফুল। হলদে ফুলটিতে জাগছে নতুন আশা। লাভজনক হওয়ায় সূর্যমুখী চাষে ঝুঁকছেন কৃষকরাও। সরকারিভাবে দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে বীজও। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে নতুন বিনিয়োগে। এ যেন সোনায় সোহাগা। এরই মধ্যে সয়াবিন তেলের বিকল্প হিসেবেও ব্যবহার বাড়ছে রান্নায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সূর্যমুখীর আবাদ সম্প্রসারণ করা গেলে সয়াবিন তেলের আমদানি নির্ভরতা কমবে।
আরও পড়ুন>> যমুনার বালুচরে সূর্যমুখীর হাসি
সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও সূর্যমুখী ফুল চাষে এগিয়ে এসেছেন অনেক কৃষক। শৌখিন জমির মালিকরাও ধানের বদলে সূর্যমুখী চাষ করেছেন। তেমনই এক কৃষক চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের নিজাম উদ্দিন ইমতিয়াজ। চরপাথরঘাটার ইছানগর গ্রামের জিন্নাত আলী মুন্সির গোলায় নিজের ৫০ শতক জমিতে তিনি সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে বীজ ও সারসহ কৌশলগত সহযোগিতা দেওয়া হয় এ কৃষককে।
নিজাম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে দেড় বিঘা (৫০ শতক) জমিতে সূর্যমুখী ফুলের আবাদ করেছি। খরচ হয়েছে মাত্র ২০ হাজার টাকা। ঠিকমতো ফলন তোলা সম্ভব হলে এ জমি থেকেই প্রায় ৩০ হাজার টাকা লাভ করা যাবে।
আরও পড়ুন>> সূর্যমুখী বাগানে প্রবেশমূল্য ২০, বিক্রি হয় ফুল
সরেজমিনে ইছানগর গ্রামের জিন্নাত আলী মুন্সির গোলা এলাকার ওই জমিতে দেখা গেছে, মাঠজুড়ে হলদে সূর্যমুখীতে সৌন্দর্যের এক অনন্য আবহ তৈরি করেছে। আশপাশের গ্রামের নারী-পুরুষরা সূর্যমুখীর বাগান দেখতে আসছেন।
বাগান দেখভালের দায়িত্ব থাকা মো. শাহীন বলেন, প্রতিদিন শত শত মানুষ সূর্যমুখীর বাগান দেখতে আসছেন। ছবি তুলছেন, সেলফি নিচ্ছেন। শুক্রবার বিকেলে মানুষের ভিড়ে জমিতে দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না।
বাগানটি পরিদর্শন করেন বেসরকারি একটি ব্যাংকের রিটেইল অ্যান্ড এসএমই ব্যাংকিং শাখার প্রতিনিধি শিং শিং উ মারমা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যাংককেই কৃষিখাতে ঋণ দিতে হচ্ছে। কৃষি ঋণের সুদও কম। আমরা ইছানগর এলাকার সূর্যমুখী ফুলের বাগানটি ভিজিট করছি। এ ধরনের খাতে বিনিয়োগ হলে ঝুঁকি কম। কৃষকরা আগ্রহী হলে এ খাতে কৃষি ঋণ দিতে আগ্রহী ব্যাংক। এ ধরনের ঋণে প্রকৃত কৃষকরা উপকৃত হবেন বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি।
আরও পড়ুন>> সড়ক বিভাজনে হাসছে সূর্যমুখী
চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আশীষ কুমার দাশ বলেন, রবি মৌসুমে বোরো ধানের পরিবর্তে সূর্যমুখী চাষ কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। যেখানে ৫০ শতক জমিতে বোরো ধান আবাদ করলে ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা লাভ হয়, সেখানে সূর্যমুখী চাষে ২৮ থেকে ৩৬ হাজার টাকার মতো নিট লাভ হবে কৃষকের। তাছাড়া বোরো ধানের জীবনকাল ১৩০ দিন থেকে ১৪৫ দিন হলেও সূর্যমুখীর জীবনকাল ১০০ দিন থেকে ১১৫ দিন। তাই বোরো মৌসুমে সূর্যমুখী আবাদ করলে পরে একই জমিতে যথাসময়ে আউশ ধানের আবাদ করা সম্ভব হয়। এতে একই জমিতে তিন ফসলি চাষাবাদের সুযোগ থাকে।
এ মাঠ কর্মকর্তা বলেন, ইছানগর এলাকায় নিজাম উদ্দিন ইমতিয়াজকে সূর্যমুখী ফুল চাষে সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। তিনি ৫০ শতক জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ করেছেন। এ জমিতে গড় হিসাবে কম হলেও প্রায় ৪০০ কেজি সূর্যমুখী বীজ উৎপাদিত হবে। প্রতি কেজি বীজ ১২০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে ৪৮ হাজার টাকার বীজ বিক্রি সম্ভব হবে। আবার মাড়াই করলে প্রতি আড়াই কেজি বীজ থেকে এক লিটার তেল পাওয়া যায়। এতে ১৬০ লিটার তেল পাওয়া যাবে। বাজারে বর্তমানে সূর্যমুখী তেলের দাম প্রতি লিটার সাড়ে তিনশ টাকা। সেই হিসাবে তেলের দাম পাওয়া যাবে ৫৬ হাজার টাকা। অথচ ৫০ শতক জমি চাষাবাদে কৃষকের সাকুল্যে খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা।
আরও পড়ুন>> কুড়িগ্রামে সূর্যমুখী চাষে লাভের আশা
সূর্যমুখী তেল পুষ্টিসমৃদ্ধ এবং কোলেস্টেরলমুক্ত বলে জানিয়েছেন কর্ণফুলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, সূর্যমুখী তেল স্বাস্থ্যসম্মত। এ তেলে অনেক ধরনের ভিটামিন ও প্রোটিন রয়েছে। এ তেল উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগীদের জন্য উপকারী। স্বাস্থ্যসম্মত বলে সাম্প্রতিক সময়ে রান্নায় সূর্যমুখী তেলের ব্যবহার বেড়েছে।
তিনি বলেন, সূর্যমুখীর বীজ হাঁস, মুরগি, কবুতরসহ বিভিন্ন পাখির দানাদার খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এজন্য সারাবছর বাজারে এ বীজের চাহিদা থাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে ২৪ লাখ টনের। এর মধ্যে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকে দেশে উৎপাদিত হয় ৩ লাখ টন। অবশিষ্ট প্রায় ২১ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটাতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক নানান সমীকরণে আমদানি নির্ভরতা কমাতে ভোজ্যতেলের দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
বর্তমান উৎপাদনের চারগুণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে ভোজ্যতেলের উৎপাদন ১২ লাখ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে কৃষি বিভাগের। এজন্য তৈল বীজ জাতীয় ফসল উৎপাদনে কৃষকদের প্রণোদনাও দিচ্ছে সরকার।
চট্টগ্রাম কৃষি অফিসের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলায় ৬৮৮ বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫০ বিঘা জমির জন্য সূর্যমুখী ফুলের আবাদে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুচ ছোবহান বলেন, সরকার ভোজ্যতেলের ঘাটতি মেটাতে তৈল বীজজাতীয় শস্যের উৎপাদন বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে সূর্যমুখী ফুলের আবাদের জন্য কৃষকদের বিনামূল্যে বীজ ও সার সরবরাহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক মাঠে গিয়ে কৃষকদের আবাদ তদারকি করছেন। ভালো ফলনের বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রত্যেক কৃষককে এক বিঘা সূর্যমুখী চাষাবাদের জন্য এক কেজি ‘হাইসান-৩৬’ জাতের বীজ, ১০ কেজি ডিএপি এবং ১০ কেজি এমওপি সার বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে গত বছরের চেয়ে এবার সূর্যমুখীর আবাদ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। কৃষকরা আবাদে এগিয়ে এলে সূর্যমুখী ফুল একটি অর্থকরী ফসল হিসেবে রূপ নিতে পারে।
এমডিআইএইচ/এমএএইচ/এএসএম