‘খেলোয়াড়দের’ পোয়াবারো, বিপাকে বিনিয়োগকারী-ব্রোকার

সাঈদ শিপন
সাঈদ শিপন সাঈদ শিপন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:৩২ এএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

একের পর এক কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়িয়ে এক শ্রেণির বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার থেকে মোটা অঙ্কের মুনাফা তুলে নিচ্ছেন, যাদের শেয়ারবাজারে ‘খেলোয়াড়’ বা ‘বিশেষ চক্র’ বলা হয়। এই ‘খেলোয়াড়রা’ শেয়ারবাজার থেকে বড় অঙ্কের মুনাফা তুলে নিলেও শেয়ারবাজারের প্রাণ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বিপাকে রয়েছেন। সেই সঙ্গে যাদের মাধ্যমে শেয়ারবাজারের লেনদেন হয়, সেই ব্রোকারেজ হাউজ সংশ্লিষ্টরাও রয়েছেন বিপাকে।

শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বেঁধে দেওয়া ফ্লোর প্রাইসে (সর্বনিম্ন দাম) আটকে থাকায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বেশিরভাগ নতুন বিনিয়োগে যেতে পারছেন না। মাসের পর মাস লোকসানে শেয়ার বিক্রির চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হচ্ছেন।

অপরদিকে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন না হওয়ায় লেনদেনের গতিও বাড়ছে না। ফলে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ব্রোকারেজ হাউজগুলোর আয়ের একমাত্র উৎস লেনদেন থেকে পাওয়া কমিশন। লেনদেন কম হওয়ায় তাদের কমিশন আয় কমে গেছে। ফলে অনেক ব্রোকার তাদের কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

আরও পড়ুন>> শেয়ারবাজারের ‘মিরাকল’ মিরাকেল

গত ২৪ আগস্ট ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৫৭ টাকা ২০ পয়সা। ১৯ সেপ্টেম্বর লেনদেন শেষে এই কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ১১৪ টাকা ৯০ পয়সা। অর্থাৎ প্রায় এক মাসের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

শুধু ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স নয়, সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার দাম এমন অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এমন একটি কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল। গত ২ এপ্রিল কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৩০ টাকা ৮০ পয়সা। সেখান থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে এখন প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ১৫৭ টাকা ৩০ পয়সা। অর্থাৎ কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়ে পাঁচগুণ হয়েছে।

শেয়ারের এমন দাম বাড়া কোম্পানিটি ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দেয়নি। তবে সম্প্রতি ২০২২ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরের জন্য ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এরপর ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ সময়ের আর্থিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ৫ শতাংশ অন্তর্বর্তী লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। অবশ্য এই লভ্যাংশ ঘোষণা আসার আগে থেকেই অস্বাভাবিক হারে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বাড়া শুরু হয়।

শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়া আরেক কোম্পানি মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজ। সম্প্রতি কোম্পানিটির শেয়ার দাম কিছুটা কমেছে। তবে এর আগেই এক মাসের কম সময়ের মধ্যে দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। গত ১৬ আগস্ট কোম্পানিটির শেয়ার দাম ছিল ২৮ টাকা ৮০ পয়সা। সেখান থেকে দফায় দফায় দাম বেড়ে ১২ সেপ্টেম্বর প্রতিটি শেয়ারের দামে ৫৭ টাকা ৪০ পয়সায় ওঠে। অর্থাৎ এক মাসের কম সময়ের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়।

আরও পড়ুন>> এআই নির্ধারণ করবে শেয়ারের ভবিষ্যৎ মূল্য

ব্রোকারেজ হাউজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ারবাজারে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হলে বেশিরভাগ ব্রোকারেজ হাউজ ব্রেক ইভেন্ট পজিশনে থাকতে পারে। সেখানে এখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ৭০০-৮০০ কোটি টাকার লেনদেনের দেখা মিলছে। এতে বেশিরভাগ ব্রোকারেজ হাউজ লোকসানের মধ্যে পড়েছে। লোকসান হলেও ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে উৎসে কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে এই উৎসে কর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে দুই ডজনের বেশি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এর মধ্যে দুই সপ্তাহ ধরে দাম বাড়ার ক্ষেত্রে দাপট দেখাচ্ছে বিমা কোম্পানিগুলো। বেশকিছু বিমা কোম্পানির শেয়ার দাম এরই মধ্যে ৫০ শতাংশের ওপরে বেড়ে গেছে।

এর মধ্যে এশিয়া ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, জনতা ইন্স্যুরেন্স, রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স, ইস্টার্ণ ইন্স্যুরেন্সসহ কয়েকটি বিমা কোম্পানি দাম বাড়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে। এর আগে মিরাকল ইন্ডাস্ট্রিজ, ফু-ওয়াং ফুড, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ, লিগ্যাসি ফুটওয়্যারসহ বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ে।

আরও পড়ুন>> এবার উল্টো পথে লিগ্যাসি ফুটওয়্যার

হুটহাট একের পর এক কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কারণ হিসেবে শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ফ্লোর প্রাইসকে দায়ী করেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইসের কারণে এখন বাজারে ৮০ শতাংশ বিনিয়োগকারী লেনদেন করতে পারছেন না। বাজার এখন কারসাজি চক্র দিয়ে চলছে। মাঝেমধ্যে তারা বিভিন্ন কোম্পানি নিয়ে খেলাধুলা করছেন। এখন বিমা কোম্পানির শেয়ার নিয়ে খেলছেন। এর আগে এমারেল্ড অয়েল, ফু-ওয়াং ফু, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার নিয়ে খেলেছেন। বিমা কোম্পানির শেয়ার নিয়ে খেলাধুলা করেন, তারপর হয়তো তারা অন্য কোনো খাত নিয়ে খেলবেন।’

তিনি বলেন, ‘যতদিন ফ্লোর প্রাইস থাকবে শেয়ারবাজার স্বাভাবিক হবে না। এই ফ্লোর প্রাইসের কারণে কারসাজি চক্রের সুবিধা হচ্ছে। প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের এর মধ্যে কোনো উপকার হচ্ছে না। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন না হওযার কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাধ্য হয়ে কারসাজির শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন। এতে কেউ মুনাফার দেখা পাচ্ছেন, আবার কেউ লোকসান গুনছেন।’

বিনিয়োগকারী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাজার এখন আইটেমনির্ভর হয়ে গেছে। যিনি আইটেম ধরতে পারছেন, তিনি মুনাফার দেখা পাচ্ছেন। তবে বেশিরভাগ সাধারণ বিনিয়োগকারী খুব একটা মুনাফা করতে পারছেন না। কারণ তাদের বেশিরভাগ অর্থ আগে থেকেই আটকে রয়েছে। আমার কাছে তিনটি কোম্পানির শেয়ার আছে, এক বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে বিক্রি করতে পারছি না। বেশিরভাগ বিনিয়োগাকরীর এই অবস্থা।’

আবু নামের আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, ‘আমার পোর্টফোলিওতে ৮টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট আছে। এর মধ্যে মাত্র একটি কোম্পানির শেয়ার বর্তমানে লেনদেন হচ্ছে। বাকি ৭টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট এক বছরের বেশি সময় ধরে বিক্রি করতে পারছি না। এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে বড় লোকসানে রয়েছি। লোকসানে বিক্রি করে টাকা ফ্রি করবো তার উপায় নেই। প্রতিদিন লেনদেন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লোর প্রাইসে বিপুল শেয়ারের বিক্রয় আদশে আসে। অপরদিকে শূন্য পড়ে থাকে বিক্রয় আদেশের ঘর।’

আরও পড়ুন>> ২ বিমার শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম, কারণ জানে না কোম্পানি কর্তৃপক্ষ

তিনি বলেন, ‘ক্রেতার অভাবে বছরের অধিক সময় ধরে শেয়ার বিক্রি করতে পারছি না। শেয়ারবাজারে এমন অবস্থা হবে কখনো কল্পনা করতে পারিনি। কিন্তু এখন দেশের শেয়ারবাজারের এটাই বাস্তব চিত্র। মাসের পর মাস অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট ক্রেতা সংকটে পড়ে রয়েছে। ফ্লোর প্রাইসে এসব প্রতিষ্ঠানের গুটিকয়েক শেয়ার লেনদেন হচ্ছে।’

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, ‘প্রায় দুই বছর ধরে শেয়ারবাজার কঠিন সময় পার করছে। মাঝেমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এতে ‘খেলোয়াড়রা’ বড় মুনাফা করলেও সাধারণ বিনিয়োগকারীরা খুব একটা মুনাফা করতে পারছেন না। আবার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন না হওয়ার কারণে আমাদের কমিশন আয় কমে গেছে। বেশিরভাগ ব্রোকারেজ হাউজ এখন লোকসান গুনছে। মাসের পর মাস এভাবে লোকসান গুনে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা কঠিন।’

আরও পড়ুন>> ইসলামী ব্যাংকের এত শেয়ার বেচলো-কিনলো কে?

সার্বিক বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ডিএসই’র পরিচালক মো. শাকিল রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেশিরভাগ ব্রোকারেজ হাউজ বর্তমানে লোকসানে রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার লেনদেন হলে ব্রোকারেজ হাউজগুলো লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। মাসের পর মাস লোকসান হওয়ার কারণে ব্রোকারেজ হাউজের মালিকরা বর্তমানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছেন।’

তিনি বলেন, ‘কমিশন আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ওপর বাড়তি বোঝা হয়ে এসেছে উৎসে কর। ব্রোকারেজ হাউজগুলো লোকসান করলেও উৎসে কর পরিশোধ করতে হচ্ছে।’

এমএএস/ইএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।