এক বছরে খেলাপি ঋণ বাড়লো ২৫ হাজার কোটি টাকা

ইয়াসির আরাফাত রিপন
ইয়াসির আরাফাত রিপন ইয়াসির আরাফাত রিপন
প্রকাশিত: ০৯:৩১ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
  • মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯ শতাংশই খেলাপি
  • ঋণ আদায়ে ধীরগতি চলছেই
  • ঋণ খেলাপি কমাতে দৃশ্যমান উদ্যোগ-অগ্রগতি নেই
  • ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে

দেশের ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছেই। তবে এই খেলাপি কম দেখাতে এখন বেশ কৌশলী অবস্থানে ব্যাংকগুলো। খেলাপি ঋণের বিদ্যমান পরিমাণের বাইরে বিরাট অংকের ঋণ অবলোপন (রাইট অফ) করা হচ্ছে। যেটা ব্যালান্স শিটে অন্তর্ভুক্ত থাকছে না। এর ফলে খেলাপি ঋণ হিসেবে তা প্রকাশ করছে না ব্যাংকগুলো।

আবার খেলাপি ঋণ বিভিন্ন মেয়াদে রিশিডিউল করা হচ্ছে, সেখানেও পরিশোধে অনাগ্রহী ব্যক্তির এই ঋণ খেলাপি হিসেবে ঋণে গণ্য হচ্ছে না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ আশানুরূপ কমছে না। একবার কিছু কমছে তো আবার বাড়ছে বা তার পরেই প্রান্তিকেই আবার বেড়ে যাচ্ছে। চলমান অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতে অব্যাহতই আছে ঋণ আদায়ে ধীরগতি।

আরও পড়ুন: ঢালাওভাবে ঋণ বিতরণের সুযোগ বাড়লো

গত বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে পরিমাণের দিক থেকে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, একই বছরের অর্থাৎ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৯ শতাংশ।

3.jpg

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। বিরতণ করা এসব ঋণের মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯ শতাংশ। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা।

পরিশোধে অনাগ্রহী ব্যক্তির এই ঋণ খেলাপি হিসেবে ঋণে গণ্য হচ্ছে না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ আশানুরূপ কমছে না। একবার কিছু কমছে তো আবার বাড়ছে বা তার পরেই প্রান্তিকেই আবার বেড়ে যাচ্ছে। চলমান অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতে অব্যাহতই আছে ঋণ আদায়ে ধীরগতি

২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে এক বছরের ব্যবধানে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকার বেশি। তবে তার আগের প্রান্তিক অর্থাৎ সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের চেয়ে ৯ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা কমেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। যা তখন বিতরণ করা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করপোরেট গভর্ন্যান্স এবং খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের প্রধান সমস্যা। খেলাপি কমাতে ঢালাওভাবে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। বরং খেলাপি দূর করতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় গ্রহীতা ও দাতার ক্ষেত্রে একইভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আরও কঠোর হতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।

আরও পড়ুন: খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছেই। খেলাপি ঋণের বিদ্যমান পরিমাণের বাইরে বিরাট অংকের ঋণ রাইট অফ করা হচ্ছে। একটা বড় অংকের খেলাপি ঋণ বিভিন্ন মেয়াদে রিশিডিউল করা হয়। এক্ষেত্রে গ্রাহক ঋণ খেলাপি হলেও রিশিডিউল করার কারণে আর খেলাপি হিসেসে গণ্য হচ্ছেন না। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে ঋণ খেলাপিরা নানা প্রতিবন্ধকতায় থাকেন, খেলাপির চাপে অনেক সময় মারাও যান। ঋণ খেলাপি বাড়ি ভাড়া নিতে পারেন না, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন না, সামাজিতভাবেও নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে ঋণ খেলাপিরা মহা আনন্দে থাকেন।

তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জুন প্রান্তিক শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছিল এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এই খেলাপি মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এ প্রান্তিকটিতে দেশের ইতিহাসে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছিল খেলাপি ঋণ।

3.jpg

পরের প্রান্তিক সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ কিছুটা কমে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। যেটা ছিল বিতরণ করা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর সবশেষ ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আরও কিছুটা কমে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় নেমেছে। এটি বিতরণ করা ঋণের ৯ শতাংশ। সে হিসাবে ৬ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ ১০ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা কমেছে। যদিও বছরের ব্যবধানে তা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।

বিশ্বের অনেক দেশে ঋণ খেলাপিরা নানা প্রতিবন্ধকতায় থাকেন, খেলাপির চাপে অনেক সময় মারাও যান। ঋণ খেলাপি বাড়ি ভাড়া নিতে পারেন না, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারেন না, সামাজিতভাবেও নানা প্রতিবন্ধকতা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে ঋণ খেলাপিরা মহা আনন্দে থাকেন

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। সবশেষ ডিসেম্বর প্রান্তিক শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপির হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

আরও পড়ুন: পরীক্ষায় পাস করলে আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি পাওয়া যাবে

আলোচিত সময়ে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ, বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তবে পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠন করা ঋণ, সন্দেহজনক ঋণ ও আদালতের আদেশে খেলাপি স্থগিতাদেশ থাকা ঋণকে খেলাপি দেখালে এর পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি দাঁড়াবে।

ইএআর/এমকেআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।