বিদেশি সিনেমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

বিনোদন প্রতিবেদক
বিনোদন প্রতিবেদক বিনোদন প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:২৪ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০

একটা দেশের অর্জন বেশি আনন্দের হয় যখন সেটি নিয়ে বিদেশিদের মধ্যে আন্তরিকতা, স্বীকৃতি, উৎসাহ দেখা যায়। বিশ্বের অনেক দেশের যুদ্ধ বা স্বাধীনতাই নানা দেশের শিল্প-সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। তৈরি হয়েছে সিনেমা-গান।

সেদিক থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কতোটা আলোচিত বিশ্বজুড়ে শিল্পচর্চায়? সে খোঁজ নিতে দেখা যায় অনেক
বিখ্যাত বিদেশিরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধটি নিয়ে নানা মত ও দর্শন প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিদেশি পরিচালকদের হাত ধরে কালে কালে সিনেমাও তৈরি হয়েছে বেশ কিছু। তবে সেটা ভারতীয় গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ। দেশটিতে বলিউড ও কলকাতার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে নির্মিত কিছু সিনেমায় বেশ গুরুত্ব সহকারে জায়গা করে নিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। আবারও বিতর্কিত ভূমিকাও দেখা গেছে অনেক ভারতীয় পরিচালক-প্রযোজকের মধ্যে।

এর বাইরে হলিউডের কোনো সিনেমায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন নিয়ে কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি।

দেখে নেয়া যাক ভারতে নির্মিত কিছু সিনেমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জন কীভাবে ঠাঁই পেয়েছে।

যুদ্ধশিশু-চ্রিলড্রেন অফ ওয়ার
সুচিত্রা সেনের নাতনি রাইমা সেন অভিনীত এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০১৪ সালে। এটি পরিচালনা করেছেন মৃতুঞ্জয় দেবব্রত। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত এটি বলিউডের প্রথম কোনো সিনেমা। শুরুর দিকে এ সিনেমার নাম ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’ রাখা হয়েছিলে। তবে সেন্সরবোর্ডে ‘বাস্টার্ড’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি ওঠায় পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে ‘যুদ্ধশিশু - চ্রিলড্রেন অফ ওয়ার’ রাখা হয়।

২৫ মার্চের গণহত্যা থেকে শুরু করে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে নারী নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সিনেমায়। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনা নারীদের উপর পাকিস্তানী বাহিনীর অকথ্য নির্যাতনের চিত্র এসিনেমায় দেখতে পাই আমরা।

রাইমার পাশাপাশি এই ছবিতে ঋদ্ধি সেন, রুচা ইনামদার, রুদ্রনীল, পবন মালহোত্রা ও ভিক্টর ব্যানার্জীর অনবদ্য অভিনয় মন জয় করেছে দর্শকের। তবে ইতিহাস বর্ণনায় কিছু দুর্বলতা ও মাত্রাতিরিক্ত নৃশংসতা উপস্থাপনের কারণে বেশ সমালোচিত হয়েছে সিনেমাটি।

মুক্তি - বার্থ অফ আ নেশন
এটি একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। মনু চোবে পরিচালিত ২২ মিনিটের এ চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে কীভাবে ভারতীয় লেফটেনেন্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবের কারণে পাল্টে গিয়েছিল যুদ্ধের গতিপ্রবাহ। ২০১৭ মুক্তি পাওয়া ‘মুক্তি’ সিনেমাটিতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে খুব চমৎকার করে উপস্থাপন করা হয়েছে। মিলিন্দ সোমান, যশপাল শর্মা অভিনীত এ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটিকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম তথ্যসমৃদ্ধ একটি বিদেশি নির্মাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ইহুদি অফিসার জে এফ আর জ্যাকব যাকে ‘জেইক সুইটি’ নামেও ডাকা হতো। এ দেশের স্বাধীনতায় তার ভূমিকার কথা আমরা অনেকেই হয়ত জানি না। তারই গল্প এখানে তুলে ধরা হয়েছে। দেখানো হয়েছে পূর্ব বাংলায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সংকটময় একটি সময়ে পাকিস্তানি জেনারেল এ এ খান নিয়াজীর সঙ্গে জ্যাকবের চৌকস ও বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথন কীভাবে বদলে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

১৬ ডিসেম্বর
২০০২ মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি বলিউড অ্যাকশন স্পাই থ্রিলার। এটি পরিচালনা করেন মনি শঙ্কর। এতে অভিনয় করেন ড্যানি ডেনজংপা,গুলশান গ্রোভার, মিলিন্দ সোমান, দীপান্বিতা শর্মা, সুশান্ত সিং প্রমুখ।

সেখানে দেখানো হয় ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী পরাজয় বরণ করে নেয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে। একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য পরাজয়ের অপমান ভুলতে না পেরে ‘কালাখানজার’ নামের একটি অপরাধী চক্র গড়ে তোলে। ভারতে এ দলটি গোপনে মানি লন্ডারিং সহ নানা অনৈতিক কাজচালিয়ে যায়। ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর চার সদস্যকে দেওয়া হয় ‘কালা খানজার’ ধ্বংস করে দেওয়ার মিশন।

ঘটনাচক্রে ২০০১সালের ১৬ ডিসেম্বর নয়া দিল্লিতে একটি জঙ্গি হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে ‘কালা খানজার’। ১৯৭১ সালের সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের দিনটির কথা মাথায় রেখেই এই তারিখ নির্ধারণ করে তারা।

১৯৭১
এ সিনেমাটি বলিউডে মুক্তি পায় ২০০৭ সালে। অমৃত সাগর পরিচালিত এ সিনেমায় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী ছয় ভারতীয় সৈন্যের পালিয়েভারতে আসার গল্প বলা হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে লড়তে আসা ছয় ভারতীয় সৈনিক বন্দী হয় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। ছয় বছরকারাবন্দী থাকার পর ১৯৭৭ সালে জেল পালিয়ে স্বদেশে ফিরে আসেন তারা। এমনই এক চমকপ্রদ গল্প নিয়ে নির্মিতহয়েছে সিনেমাটি।

এতে অভিনয় করেছেন মনোজ বাজপায়ী, রবি কিষান, কুমুদ মিশ্র, মানব কউল, দীপক দব্রিয়াল, পিযূষ মিশ্র প্রমুখ।

অসাধারণ নির্মাণশৈলী ও চমৎকার অভিনয়ের জন্য সিনেমাটি সমালোচকদের দৃষ্টি কাড়ে। ২০০৭ সালের সেরা সিনেমা হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে ‘১৯৭১’। ছবিটি বাংলাদেশের দর্শকের কাছেও বেশ সমাদৃত।

গয়নার বাক্স
বরাবরই বাংলাদেশ ও এদেশের মানুষ, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে এসেছেন কলকাতার বিখ্যাত অভিনেত্রী ও পরিচালক অপর্ণা সেন। তিনি ২০১৩ সালে নির্মাণ করেন হরর কমেডি সিনেমা ‘গয়নার বাক্স’। এখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন অপর্ণা। সিনেমায় দেখা যায় ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পূর্ববাংলা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমানো হিন্দু বিধবা নারী রশোমনির গচ্ছিত গহনা মৃত্যুর পর পায় তার ভাইয়ের ছেলের বউ সোমালতা। তার কাছ থেকে সেগুলো পায় তার মেয়ে চৈতালী।

আধুনিক যুগের মেয়ে চৈতালি যখন বড় হয় তখনই পূর্ববঙ্গে শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। ২৫ মার্চের নির্মম গণহত্যার পর পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে পালিয়ে আসে অসংখ্য শরণার্থী। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে শুরুহয় মুক্তিবাহিনী গঠন। মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে চৈতালি তার সমস্ত গহনা দান করে দেন মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে।

এ সিনেমায় ভূত রশোমনি ও সোমলতা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জেতেন অভিনেত্রী মৌসুমীচ্যাটার্জী ও কঙ্কনা সেন শর্মা।

গুন্ডে
প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, রণবীর সিং, অর্জুন কাপুর, ইরফান খান অভিনীত এই সিনেমাটি মুক্তিযুদ্ধের ভুল তথ্য উপস্থাপন করে বেশ বিতর্কের জন্ম দেয়। ২০১৪ সালে নির্মিত এ সিনেমায় দেখানো হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে পালিয়ে আসা দুই এতিম শিশু বিক্রম ও বালার গুন্ডা হয়ে ওঠার গল্প। এখানে ‘ভারত-পাকিস্তানের তৃতীয় যুদ্ধের ফসল বাংলাদেশ’- এমন সংলাপ থাকায় এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বাংলাদেশে। কূটনৈতিক মহলেও এ নিয়ে বেশ উত্তেজনা দেখা যায়।

১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে প্রচার করাকে মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশও পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসবিদরাও। নানা প্রতিবাদের মুখে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয় ছবিটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘যশরাজ ফিল্মস’। তবে সিনেমার মধ্যে সেই সংলাপটি এখনো রয়েই গেছে।

দ্য গাজী অ্যাটাক
এ সিনেমাটি ২০১৭ মুক্তি পায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তান বাহিনীর নৌ-যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিনেমা ‘দ্য গাজী অ্যাটাক’। করণ জোহরের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘ধর্ম প্রডাকশন’-এর ব্যানারে নির্মিত এ সিনেমায় অভিনয় করেছন রানা দগ্গুবতী, অতুল কুলকার্নি, তাপসী পান্নু, কে কে মেনন প্রমুখ।

বিজয় নিশ্চিত হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর বঙ্গোপোসাগরে রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায়পাকিস্তানী সাবমেরিন পিএনএস গাজী। গাজীর চেয়ে কম শক্তিসম্পন্ন ‘আইএনএস রাজপুত’ দিয়ে শক্তিশালী এ সাবমেরিন ডুবিয়ে দেওয়ার গল্পই উঠে এসেছে সিনেমাটিতে। এখানে বাংলাদেশি শরনার্থী নারী চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘পিঙ্ক’ অভিনেত্রী তাপসী পান্নু।

এলএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।